ছোট বাচ্চাদের বেড়ে ওঠার প্রতিটা ধাপ দেখা কতই না আনন্দের! একদম যখন ছোট থাকে, যখন ওরা ঘাড় সোজা রাখতে পারে না, তখন ওদের কোলে নিতে আমি এখনও ঠিকমত পারি না। আমার মনে হয় আমি ঠিকমত নিতেই পারবো না, নিলে মনে হয় বুঝি ওরা ব্যথা পাবে। আমি বাচ্চাদের নেই মোটামুটি দুই মাস বয়স থেকে। তখন ওরা মুখের দিয়ে তাকিয়ে নানা ধরণের ভাবভঙ্গি করতে শিখে। বাচ্চাদের মুখ থেকে করা সেই নানা ধরণের শব্দে ওদের যে আকুতি লুকিয়ে থাকে, ওরা যে চোখেমুখে কথা বলতে থাকে, সেটা তর্জমা করার সাধ্য তো আমার নেই, তবে যে কোন প্রিয়তম গানের সুরের চেয়েও বেশী মধুর লাগে ওদের মুখ থেকে নির্গত নানা রকমের শব্দ! এরপর ওদের আসতে আসতে বেড়ে ওঠা, উপুড় হতে শেখা, বসতে শেখা, জিনিসপত্র নিয়ে মুখে চালান করতে শেখা, হামাগুড়ি দেয়া, এরপর হাঁটি হাঁটি পা পা করতে করতে বার বার আছাড় খেয়ে হাঁটতে শেখা, সবকিছুর মধ্যেই একটা ছন্দ আছে। জীবনের ছন্দ! সবকিছুই কবিতার মত শাশ্বত সুন্দর। সেই সব কবিতার মত যেগুলো মনের সৈকতে ক্রমাগত ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়ে, কিন্তু কোন কবিতার ছত্রে বাঙময় না হয়েও যে কবিতা! আমার সৌভাগ্য, আমি আমার মেয়েটার বড় হয়ে ওঠা দেখেছি চোখের সামনেই। এখন দেখছি আমার ছেলেটার ক্রমবিকাশ। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ আমাকে এই অপার অবারিত আনন্দ দানের জন্য।
আজকে আমার নিজের বাচ্চাদের কথা না। আমার স্ত্রীর বড় ভাতিজার কিছু মজার স্মৃতিচারণ করি না হয়? কারণ আমি এই বাচ্চাটাকেও চোখের সামনেই বড় হতে দেখেছি। আমার মেয়ের প্রিয় ভাই, সামি ভাইয়া! এখন অবশ্য ‘সামি’ নামটা ঠিকমতই উচ্চারণ করে আমার মেয়ে। কিছুদিন আগেও বলতো ‘সামবাইয়া’! সামির বয়স এখন ১১ বছর। আমার যখন বিয়ে হয় সেই ২০০৯ সালে তখন ওর বয়স ছিল মাত্র ৬ মাস। যেদিন আনুষ্ঠানিক ভাবে সামির ৪র্থ ফুফুকে দেখতে গেলাম বিয়ের উদ্দেশ্যে, সেদিন সামিও গিয়েছিল আমাকে দেখতে। মেয়ের মামার বাসায়, ডাইনিং টেবিলে বসে মাথা দুলায়ে দুলায়ে আমার সাথে খেলা করছিল ছেলেটা। মাত্র বসা রপ্ত করছিল, আমি দুই হাত দিয়ে ধরে রেখেছিলাম। বাচ্চাদের গায়ে যে স্বর্গীয় গন্ধ লেগে থাকে, খেলার ছলে ছলে আমি ওর বুকে পেটে নাক ঘষে ঘষে ওকে হাসাচ্ছিলাম আর গন্ধ নিচ্ছিলাম। এটা ছিল সামির সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ! এরপরে বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। বিয়ের ৪ দিনের মাথায় চলে গেলাম, সিঙ্গাপুরে। এক বছর পরে ২০১০ সালে যখন বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সারার জন্য ছুটি নিয়ে দেশে এসেছি, তখন সামি হাঁটা শিখে গেছে। সামির নিয়মিত আপডেট আমি আমার স্ত্রীর কাছ থেকে নিতাম। তখন থেকেই আমি সামিকে ডাকি ‘শশুর’ বলে, এখনও বলি! অনুষ্ঠানের জন্য যখন দেশে এলাম, তখন আমার ‘শশুরের’(!) বয়স মাত্র ১ বছর ৪ মাস! সারা বাসা দৌড়ায়ে বেড়ায়। কথা বার্তা একটু একটু যৎসামান্য আর কি! মেহেদি সন্ধ্যার রাতে যখন ওবাড়িতে গেলাম, তখন দেখি আমার এই ক্ষুদে শশুর আমাকে রিসিভ করার জন্য মেইন গেটের পাল্লা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি শশুর-সাহেবকে কোলে করে নিয়ে মেহেদী সন্ধ্যার আসরে হাজির হলাম! ঐ বাসায় যতক্ষণ থাকতাম, সামি আমার কাছেপিঠেই থাকতো। হাঁটতো থপথপ করে। আর হেঁটে এসেই আমার আমার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আমার মুখের দিকে তাকাতো। এর মানে হল ওকে কোলে নিতে হবে!
২০১২ সালে আবার যখন ছুটিতে দেশে আসলাম, তখন আমার এই ক্ষুদে শশুর আরো একটু বড় হয়েছেন। সব রকমের কথা, যার কিছু শ্রাব্য কিছু ‘না-শ্রাব্য’(!) সব রকমই ছিল। সব বাচ্চারাই মনে হয় ঋণাত্মক কিছু শব্দ কিভাবে যেন আয়ত্ব করে ফেলে। সামি অবশ্য খুবে বেশী কিছু বলতো না। চতুষ্পদী ‘সারমেয়’র কথ্য রূপটাই সামি তার রাগ প্রকাশের জন্য উপযুক্ত শব্দ হিসেবে বেছে নিয়েছিল। যার উপরেই রাগ হোক না কেন, টান দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠতো, ‘কুত---তা----হ’! যত বেশী রাগ, তত জোরে টান! রাগের মাত্রা কম হলে, ছোট ছোট করে, ‘এই কুত্তা, এই কুত্তা, এই কুত্তা...’ এটা ক্রমাগত বলে যেত। যেহেতু বাচ্চারা অপ্রীতিকর কোন শব্দ উচ্চারণ করলে বড়দের নিয়ম হল সেটার উপরে হাসাহাসি না করে, বাচ্চাটার মন অন্যদিকে সরিয়ে দেয়া। এটা নিয়ে ওদের কিছু বলতে গেলেই ওরা আরো বেশী করে করা শুরু করে। বাসার সবাই যথাসাধ্য তাই করতো। আমি আমার ক্ষুদে শশুরের এই বাক্যবাণের শিকার বহুবার হয়েছি এবং অনেকটা ইচ্ছা করেই। বাচ্চাদের মুখের যে কোন কথা শুনতেই আমার ভাল লাগে। যেটা গালিগালাজই হোক না কেন! যদিও শুনে শুনে আমি মজা নিতাম কিন্তু ওকে বুঝতে দিতাম না। এমন ভাব করতাম ওর মুখে ‘কুত-তাহ’ শুনে আমি মারাত্মক রকমের মন খারাপ করে ফেলেছি!
সামির ঐ বয়সেই প্রিয় খেলা ছিল মোবাইল ফোনের গেম খেলা। বিশেষ করে নোকিয়া সেটের সাপের খেলাটা। আমাকে ও তখন ডাকতো ‘শান ফু-’ বলে! ‘শাওন ফুফা’ কথাটার একটা সুবিধাজনক সংক্ষেপ ও নিজে থেকেই বের করে নিয়েছিল। আমাকে দেখলেই মোবাইল চাইতো। আমি ওর দিকে মোবাইল বাড়িয়ে দিতাম, কিন্তু ও বুঝতো মোবাইল লক করা আছে কিনা। আমাকে ওর্ডার করতো, ‘লক খুইলা দে’! পারফেক্ট শশুর সুলভ হুকুম যাকে বলে! আমি ওর সামনে খুলে আবার ওর হাতে দেয়ার আগে ইচ্ছা করে আবার লক করে দিতাম! ও যেই দেখতো মোবাইল কাজ করছে না, তখন রাগে গজগজ করতে করতে বলতো, ‘অই কুত্তাহ! তুই মোবাইল লক কইরা দিসোস ক্যা’? ওর মুখে এই কথাটা শোনার জন্যই আমিও ইচ্ছা করেই লক করে মোবাইল ওর হাতে দিতাম!
একদিন আমার আসল শশুর সাহেব (হাজী রফিকুল ইসলাম) একটা বড়সড় কাঁঠাল নিয়ে এলেন বাসায়। উনি তখন উনাদের এলাকার ওয়ার্ড-কাউন্সিলর! কাঁঠাল এনে মেঝেতে রাখার সাথে সাথেই সামির কি খেয়াল হল, হাতের মোবাইল ছেড়ে দিয়ে গিয়ে কাঁঠালের উপরে দাঁড়াবে! গিয়ে দাঁড়ালোও তাই। আমার শশুর সাহেব তার আদরের দৌহিত্রকে কাঁঠাল থেকে নেমে যেতে বললেন! সামি মনে করলো, তাকে বকা দেয়া হয়েছে! এরপর শুরু হয়ে গেল দাদার উদ্দেশ্যে সামির বাক্যবাণ নিক্ষেপ, ননস্টপ! ‘কুত-তাহ, কুত-তাহ, কুত-তাহ......’! আমার শাশুড়ি ত্রাহি ত্রাহি করতে করতে রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন স্বামীকে উদ্ধার করতে। তার কাউন্সিলর স্বামী’র এতবড় অপমান(!) উনি দেখবেন কি করে? কিন্তু এসেই উনি কি অদ্ভুত জাদুবলে পল্টী খেয়ে সামির পক্ষ নিয়ে স্বামীকে তিরস্কার করতে লাগলেন, ‘আপনি ওরে বকা দিসেন ক্যান’? আমার আসল শশুর-সাহেব ঘটনা বেগতিক দেখে পালিয়ে বাঁচলেন! সামি আরো বার কয়েক বাক্যবাণ ছুঁড়ে ঠান্ডা হয়ে আবার মোবাইল নিয়ে বসলো! আমি ঘরের ভেতর গিয়ে হাসিতে ফেঁটে পড়ালাম! হাসতে হাসতে আমার হেঁচকি উঠে গেল। আমার স্ত্রীকে বললাম, তোমার কমিশনার বাপের উচিত শিক্ষা হইসে আজকে!
আমার শ্যালিকা হঠাৎ হঠাৎ এসে ভাতিজা সামিকে জাপটে ধরে আদর করা শুরু করে। দুই হাত পাকড়াও করে দুই গালে চুমু দিয়ে ভরে দেয়। বিনিময়ে সামি আনন্দের আতিশয্যে তার ছোট ফুফুকে পুরষ্কার দেয়, ‘কুত-তাহ! ঐ কুত-তাহ তুই চুমা দিসোস ক্যা’? একবার ওদের দুইজনকে নিয়ে গেলাম চিকেন ফ্রাই খেতে। আমার শ্যালিকার ড্রিঙ্কস শেষ হয়ে যাওয়াতে সামির ড্রিঙ্কসে বেচারী একটা মাত্র চুমুক দিয়ে বসে। ব্যস হয়ে গেল! সামি চিকেন ফ্রাই খাচ্ছিলো মন দিয়ে, কিন্তু দেখে ফেললো ওর ড্রিঙ্কসে চুমুক দেয়া হয়েছে। সাথে সাথে শুরু হয়ে গেল, ‘ঐ কুত-তাহ তুই আমার ড্রিঙ্কস খাইসোস ক্যা’? আমি আর আমার স্ত্রী তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করলাম! আমার ক্ষুদে শশুরের কিছু আশীর্বাদ-বাণী আমাদের উপরও ঝরে পড়লো!
আমার মেয়ের প্রিয় ‘সামবাইয়া’ এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। ভীষণ রকম লাজুক হয়েছে। আমার দেখা অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভদ্র একটা ছেলে। কারো সাতে পাচে নাই। ছোট ভাই বোন গুলাকে অনেক আদর করে। সামি লম্বায় তো প্রায় আমাকে ধরেই ফেলেছে। এইতো মাত্র কয়েকদিন আগে সামিকে বললাম, তুমি না এইসব এইসব বলতে জানো? বেচারা লজ্জায় একেবারে বেগুনী হয়ে গেল। বারবার আমাকে অনুরোধ করতে লাগলো, ‘ফুফা, এইসব এখন আর বইলেন না প্লিজ!’ আহা বেচারা! ওর সামনে বলিনা ঠিকই কিন্তু আমার স্ত্রীর সাথে নিয়মিত এগুলা বলি আর হাসাহাসি করি।