পূর্বপুরুষদের কথা কি আপনাদের কারো মনে পড়ে? যাদের বংশ পরম্পরায় আমরা এই পৃথিবীতে এসেছি? আমরা কি কেউ তাদের মনে রাখতে চেষ্টা করেছি? নাকি তারা একসময় আমাদের স্মৃতি হয়ে যাবে শুধু? কখনও কি মনে হয়, তারাও একসময় এই পৃথিবীতে দাপটের সাথে ছিল! কিন্তু আজ তারা নেই। এমনকি তাদের নামও আজ নেই। খুঁজেও পাওয়া যাবে না। অনেক ঘাটাঘাটি করলে হয়ত কিছু পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু এসবের ইতিহাস ক’জন মনে রাখে? ঐতিহাসিক কিছু ব্যক্তি ছাড়া খুব কম মানুষের পূর্বপুরুষের ঠিকুজি লেখা থাকে। আমার খুব মনে পড়ে তাদের জীবনের কথা। আমার দাদা, তার দাদা, তার বাবা, দাদা এভাবে যেতে যেতে... কেমন ছিল তাদের জীবন যাত্রা? তাদের বাসা? কেমন পোষাক পরতো তারা? তাদের বিয়ে শাদী? কেমন হত তখন অনুষ্ঠান? কি ছিল তাদের ধর্ম? এখন আমি যে ধর্মের অনুসারী, আজ থেকে তিন চারশ বছর আগে আমার যে পূর্বপুরুষ ছিল, তার ধর্ম কি একই ছিল? না অন্য কিছু? কি খেত তারা তখন? তাদের বাসস্থান কোথায় ছিল? তাদের জীবনে প্রেম, ভালবাসা, চাওয়া, পাওয়া? কোথায় তাদের সমাধি? কোন চিহ্ন আদৌ আছে কি? কে কোথায় ছিল? কেমন ছিল? কি ছিল? আমাকে এইসব প্রশ্ন তাড়িয়ে বেড়ায়! কে দেবে আমার এই সব প্রশ্নের জবাব? কেউ নেই কোথাও। নেই কিছু নেই।
১৯৯২ সালের ঘটনা। তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। তখন থেকেই আমার পূর্বপুরুষদের জানার ব্যাপারে আগ্রহ জন্মে যায়। কিভাবে ঘটে সেই ঘটনা আপনাদের সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করছি। গ্রামের বাড়ী বেড়াতে গিয়েছি। আমার এক ফুফুর সাথে রেল লাইনের ধারে ঘুরতে যাব বলে উনার সাথে হাটছি গ্রামের ভেতর দিয়ে। রেল লাইনের কাছাকাছি এসে একটা খেঁজুর গাছের নীচে অনেক পুরানো একটা কবর চোখে পড়লো। ইট দিয়ে পাকা করা কিন্তু তার বেশীরভাগই মাটির নীচে দেবে গেছে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে সেই কবরের পাকা দেয়ালে সিমেন্টের ভেতর এপিটাফ খোদাই করা ছিল শেওলায় ঢাকা। মৃত ব্যক্তির নাম এবং মৃত্যু তারিখ। নাম পড়ে দেখলাম, ‘বাগু শেখ’। শেখ টাইটেল দেখেই কেমন যেন মনে হল, এই লোকটা আমাদের বংশের কেউ না তো? হলেও তো হতে পারে। আমরা ‘শেখ’ হলেও এই টাইটেল ব্যবহারের কোন চল আমার দাদার আমল থেকেই নেই। আমি ফুফুকে জিজ্ঞাসা করলাম বাগু শেখ কে? তুমি চেন? ফুফু কিছু তেমন বলতে পারলেন না। আমার কৌতুহল গেল না। মাথার মধ্যে থেকে বাগু শেখ যাচ্ছিল না একেবারেই। আমার দাদু বাড়ীর সাথেই সংলগ্ন ছিল আমার দাদার আপন বোনের বাড়ী। যার বিয়ে হয়েছিল তারই আপন চাচাত ভাই এর সাথে। সেই দাদার নাম ছিল নিলু মিয়া। আমি গিয়ে নিলু দাদাকে জিজ্ঞাসা করলাম দাদা বাগু শেখ কে? তুমি বললেন, তুমি কোথায় পেলে এই নাম? আমি বললাম কবরে নাম পড়ার ঘটনা। উনি তখন আমাকে পাশে বসিয়ে বললেন, এই বাগু শেখ হচ্ছে আমার মেঝো চাচা! অর্থাত আমার নিজের দাদার আপন মেঝো চাচা! আমি খুব উৎসাহী হয়ে উঠলাম। আমি নিলু দাদাকে জিজ্ঞাসা করলাম উনাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে। আমার বাবা কেবল মাত্র তার নিজের দাদার নামটাই শুধু বলতে পারতেন। তাদের ভাই কজ’ন ছিল এবং তাদের নাম কি ছিল সেটা আমি বলতে পারতাম।
নিলু দাদা আমাকে বললেন, তোমার দাদার বাবার নাম হল ‘তছির উদ্দিন শেখ’। এখানে বলে রাখা ভাল, কাকতালীয় ভাবে হলেও সত্যি যে আমার আম্মু আর আব্বুর দাদার নাম একই অর্থার ‘তছির উদ্দিন শেখ’ কিন্তু একই মানুষ নন। একজন খুলনার অধিবাসী আরেকজন তৎকালীন বৃহত্তর ফরিদপুরের। নিলু দাদা বলতে থাকলেন। আমি সেটা আমার ভাষায় বলছি। আমার দাদার বাবারা ছিলেন ছয় ভাই। আমার দাদার বাবা ছিলেন পাঁচ নাম্বার ভাই। উনাদের কোন বোন ছিল কিনা সে ব্যাপারে আমি কোন গবেষণা করিনি। এখন মনে হয়, করা উচিত ছিল! এখন আফসোস করে কোন লাভ নেই। নিলু দাদার কাছ থেকে শেখা আমার দাদার বাবা অর্থাৎ আমার বড় আব্বার ভাইদের সিরিয়াল ছিল এমন-
১। আগু শেখ
২।বাগু শেখ
৩।সব্দু শেখ (অপ্রাপ্ত বয়সে মৃত্যুবরণকারী)
৪। বশির উদ্দিন শেখ
৫। তছির উদ্দিন শেখ (আমার দাদার বাবা)
৬। দুদো শেখ (নিলু দাদার বাবা)
নামগুলা আমি মুখস্ত করে ফেললাম সপাটে। সবাইকে বলে বলে তাক লাগিয়ে দিতে থাকলাম। আমার চাচা ফুফুরা বলাবলি করতে লাগলো আমরা যা কোনদিন পারিনি, ভাতিজা সেসব খবর নিয়ে ফেলেছে। আমার উৎসাহ বেড়ে গেল। মনে হতে লাগলো, আমার আরো উপরের সিঁড়িতে উঠতে হবে। এবার টার্গেট হল দাদার দাদার নাম খুঁজে বের করতে হবে। আব্বু আর ফুফুদের জিজ্ঞাসা করলাম। সবাই আকাশ থেকে পড়লো। কেউ জানে না। আমার উৎসাহ দেখে আব্বু বললো, তোমাকে ধলা মিয়া কাকার সাথে পরিচয় করায়ে দিব। অনেক পুরানো মানুষ এখনও বেঁচে আছেন। উনি হয়তো তোমাকে আরো কিছু বলতে পারবেন। পরদিন দেখা হল ধলা মিয়া দাদার সাথে। উনি আমার আগ্রহ দেখে খুশি হলেন। দাদার বাপ-চাচাদের সিরিয়াল বলতে পারলাম দেখে খুশি হলেন। এবার আমি বললাম, দাদার দাদা কে ছিল আপনি বলতে পারেন? উনি বললেন, জানি। তোমার দাদার দাদার নাম ছিল, ‘হিম্মত উল্লাহ’। ধলা দাদা আমাকে উনার আরেক ভাই এর নাম বলতে পেরেছিলেন। তার নাম ছিল ‘হুরমত উল্লাহ’।পরবর্তীতে আমি জেনেছিলাম, উনাদের আরেক ভাই ছিল যার নাম ছিল, ‘কুদরত উল্লাহ’। এই কুদরত উল্লাহর নাম ধলা দাদা বলতে পারেননি।
আমি উৎসাতের বাড়াবাড়িতে বললাম, দাদা হিম্মত উল্লাহর বাবার নাম কি? উনি বললেন, ‘কবিদ উদ্দিন’ আর তার ভাইয়ের নাম ছিল ‘তবিদ উদ্দিন’। আপনারা নিশ্চই বুঝতে পেরেছেন এই কবিদ উদ্দিন ছিলেন আমার দাদার বড়-আব্বা! ধলা দাদা এই সিঁড়ির উপরে আর যেতে পারেননি। ধলা দাদা আর বেঁচে নেই। গ্রামে আর এমন কেউ এখন আর বাকী নেই যে আমাকে আর উপরের সিঁড়িতে নিয়ে যেতে পারে। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, পরপারে গিয়ে আমি সৃষ্টিকর্তাকে বলবো, ‘প্রভু! আদি পিতা আদম (আঃ) থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত আমার পুরা বংশকে আমাকে দেখাও। পৃথিবীতে পারিনি, এখন আমার চোখ জুড়াও, তাদের দেখি একবার!’।
পাঠকের সুবিধার্থে আমার সন্তান থেকে শুরু করে যে পর্যন্ত আমি জানি উর্ধ্বসিঁড়ি পুর্বপুরুষের ধাপে, আপনাদের আর একবার নিয়ে যাই। ক্রমটা এরকমঃ
নুয়াইয়ামান → জায়েদ → জাকির হোসেন → ইসহাক মিয়া → তছির উদ্দিন শেখ → হিম্মত উল্লাহ → কবিদ উদ্দিন → .........