জানাজা নামাজ নিয়ে গতকাল বলছিলাম। আজ আবার কিছু কথা মনে পড়ে গেল। গত শুক্রবারের ঘটনার জের ধরেই বলছি আবার। শুক্রবারে জানাজা নামাজ আগে না পড়িয়ে মুনাজাত আগে করা হল। মুনাজাতের আগে ওমুক ওমুক এই দোয়া চেয়েছে সেটা বিস্তারিত শোনানো হল। শুরু হল দীর্ঘ মুনাজাত! এরপর জানাজা নামাজের জন্য যখন আমরা দাঁড়ালাম তখন মসজিদের মুসল্লী প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। ইমাম সাহেব দাঁড়িয়েই মাইকে খোঁজ করলেন, ‘মৃতের কে আছেন? সামনে আসেন! পরিচয় দেন’! আমাকে কেউ কি একটু উল্লেখ করে বলতে পারেন, মৃত ব্যক্তির নাম ধাম পরিচয় জানতেই হবে, বা তার তরফ থেকে সবার কাছে মাফ চাইতে হবে বা দোয়া চাইতেই হবে, ইসলামে কি এমন বাধ্য বাধকতা কোথাও আছে? মৃত ব্যক্তির সাথে কারো দেনা পাওনা আছে কিনা সেটা তারা নিজেরাই খুঁজে নিবে। মাসজিদে উপস্থিত সবার সামনে সেটা নিয়ে ঘোষণা দেয়ার কি আছে?
হজ্জের সময় বা বিশ্ব-এস্তেমায় সংগঠিত জানাজা নামাজে তো এমন ঘোষণা বাধ্যতামুলক নয়! দোয়া চাওয়া দোষের কিছু নয় আমি জানি। কিন্তু এটাও আমাদের বোঝা উচিত যে, Public Speech দেয়ার মত যোগ্যতা সবার সমান থাকে না। মাইকে সবাই কথা বলতে পারে না। অনেকেই নার্ভাস হয়ে যায়। যার আত্মীয় মারা গেছে, খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা অনেক শোকগ্রস্ত থাকে। এই অবস্থায় তাকে জোর করে কেন সবার সামনে কথা বলতে বাধ্য করতে হবে? এটা কি কোন সুস্থ বিবেকের কাজ? ইমাম সাহেবের দুই তিনবার ঘোষণা করার পরে মৃত ব্যক্তির ছেলে মাইকে এল। কান্নায় তার গলা কাঁপছিল। এই অবস্থায় সে আমাদের সমাজের চিরায়ত নিয়মানুসারে সেই কথাগুলাই বললো। কিন্তু স্পষ্টই বুঝতে পারছিলাম, পিতার মৃত্যুতে অস্বাভাবিক মন খারাপ এবং কান্না জড়িত কন্ঠে মাইকে কথা বলতে ছেলেটার যথেষ্ট কষ্ট হচ্ছিল। অথচ জানাজা নামাজের পূর্বে ‘একজন বালেগ/বয়স্ক পুরুষের জানাজা’ এই কথাটুকুই বলা যথেষ্ট ছিল।
জানাজা জানাজ পড়ানোর বা ইমামতি করার অধিকার সবচেয়ে বেশী রাখে মৃত ব্যক্তির আত্মীয় স্বজনরা। এই ব্যাপারে আমরা অনেকেই সচেতন নই একেবারে। আর আমাদের ধর্ম সম্পর্কে উদাসীনতা এজন্য অনেক অনেক বেশী দায়ী। আমাদের সমাজের ক’টা পুরুষ জানাজা নামাজ পড়ানোর যোগ্যতা রাখেন সেটা নিজেকেই একবার প্রশ্ন করে দেখি। আমার নানু যখন ২০১২ তে মারা গেলেন, তখন আমি আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলাম, নানুর জানাজা নামাজ আমি পড়াবো। আমার মামা খালারা কেউ এবারে উচ্চবাচ্য করেণনি কারণ তারা খুব ভাল করেই আমার ধর্মীয় এই যোগ্যতার কথাটুকু জানতেন। নানুর মৃতদেহ ইদগাহে নেয়া হল। সবাইকে কাতারবন্দী করে পরে আমাকে এগিয়ে দেয়া হল জানাজা নামাজ পড়ানোর জন্য। মসজিদের ইমাম মুয়াজ্জিন আমার পেছনে কাতারে দাঁড়িয়ে গেলেন। আমি জানাজা পড়াতে গিয়ে কোন প্রচলিত রীতির কথা বলিনি, বরং সবিনয়ে অনুরোধ করেছিলাম নিজের মৃত্যুর কথা স্মরণ করে রাসুলের হাদীসের নির্দেশনা অনুযায়ী একাগ্রচিত্তে দোয়া করার জন্য।
জানাজা নামাজের ইমামতির জন্য যে মৃতের আত্মীয় স্বজনকে আগে ডাকা উচিত, সেটা জানা থাকলেও আমি তেমন কোন ইমাম সাহেবেকে দেখিনি এ ব্যাপারে উদার মানসিকতার পরিচয় দিতে। উনারা মনে হয় ধরেই নেন, জানাজা উনারাই পড়াবেন। এজন্য যোগ্য আত্মীয় কেউ আছে কিনা সেটা খোঁজার চেষ্টা মনে হয় উনারা করেন না। আর মুখ ফুটে অনেক আত্মীয়ও সেটা বলতে পারে না, মনে মনে ভাবে, ইমাম সাহেব বুজুর্গ মানুষ। উনার সামনে আমি কিভাবে গিয়ে বলি আমি জানাজা পড়াই! সবাই ভাবে হয়ত ইমাম সাহেবের সাথে বেয়াদবী হয়ে যাবে! আশ্চর্য আমাদের ধারণা। যেটা করা উচিত ছিল সেটার জন্য এগিয়ে না গিয়ে আমরা অন্যকে এগিয়ে দিলাম নিছক লোকাচারের জন্য। আপনারাই বলুনতো, মৃতের জন্য সত্যিকার আন্তরিক দোয়া কার বুক চিরে বের হবে? মৃতের নিকটাত্মীয়ের? নাকি সেই ইমাম সাহেবের, যার সাথে হয়ত দূর দূর দিয়েও মৃতের কোন সম্পর্ক ছিল না?
আমার দাদু মারা গিয়েছিলেন ২০০৬ এর আগষ্ট মাসের ৮ তারিখে। সংবাদ শুনে আমরা ছুটে গিয়েছিলাম গ্রামের বাড়ীতে। আমার আব্বু তখন দেশে ছিলেন না। ইংল্যান্ডে ছিলেন। আব্বু আমার ধর্মীয় জ্ঞান সম্পর্কে ধারণা রাখলেও বুঝতে পারেননি যে দাদুর জানাজা নামাজ পড়ানোর জন্য আমাকে বলা যেত। আমার উপস্থিত চাচারাও কেউ এই ব্যাপারে চিন্তা করলো না। অথচ আমি মনে মনে জানাজা পড়ানোর পুর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। গ্রামের একজন প্রসিদ্ধ আলেম যিনি ‘মেঝো হুজুর’ বা এই জাতীয় কিছু বলে পরিচিত ছিলেন। তাকে ডাকা হল। তিনি অনেক কিছু বলে কয়ে জানাজা পড়ানো শুরু করলেন! উনি যদি একবারও খুঁজতেন জানাজা পড়ানোর মত কোন আত্মীয় আছে কিনা, খুজলেই আমি এগিয়ে যেতাম। কিন্তু আমি দেখলাম, যখন আমার আত্মীয়রাই এ ব্যাপারে সচেতন না, আমি আর কিছুই বললাম না। মন খারাপ করেই ‘হুজুর’ এর পিছে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলাম। পরে আব্বুকে বললেছিলাম, দাদুর জানাজা নামাজ আমাকে পড়াতে দেয়া উচিত ছিল। শুনে উনি বললেন, তুমি পার? আগে বল নাই কেন? আমি অভিমান নিয়ে বললাম, বলতে হবে কেন? তোমরা জান না? কেউ তো আমার খোঁজ করেনি। এজন্য আমিও আর কিছু বলিনি। ২০১৭ তে আমার চাচী মারা গেলেন। এবার আমি ইচ্ছা করেই কিছুই বলিনি। কি দরকার? গ্রামের মানুষের ধারণা মনে হয় মসজিদের ইমাম সাহেবরা ছাড়া জানাজা নামাজ আর কেউ পড়ে সেটা আল্লাহর কাছে পৌঁছাতে পারেন না। তারা ভাল থাকুক তাদের ধারণা নিয়ে। আমার আব্বুও উপস্থিত ছিলেন। উনিও ভুলে গেলেন আমি জানাজা পড়াতে পারি। আমিও ভুলে গেলাম, আমি বলি যে জানাজা আমি পড়াই! কি দরকার! আমি তো মসজিদের ইমাম নই!