‘জানাজা নামাজ’ হল এক বিশেষ ধরণের এবং অপরিহার্য অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার প্রার্থনা যা মৃতদেহ সৎকারের পূর্বে করা হয়। দি প্রার্থনা কে ইসলামী রীতিতে ‘ফরদ্বে কেফায়া’ বলা হয় অর্থাৎ গ্রামের বা মহল্লার সবার উপরে একসাথে অপরিহার্য নয় কিন্তু কিছুসংখ্যক লোক প্রার্থনা করে ফেললেই সবাই ধর্মীয় দায়বদ্ধতা থেকে অব্যহতি পায়। এই নামাজ বা প্রার্থনা কে বিশেষ ধরণের বলার কারণ হল এর আভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক গঠনশৈলী। অন্যান্য নামাজ থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। এই নামাজে কোন কোন ‘রুকু’ এবং ‘সেজদা’ নাই। ইমামের সামনে মৃতদেহ কে গোসল দিয়ে কাফন পরিয়ে রাখা হয়। অতি সংক্ষিপ্ত নামাজ বা প্রার্থনা। এখানে জীবিতরা তাদের নিজেদের এবং মৃতের পারলৌকিক কল্যান সহ সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজেদের পাপ মুক্তির প্রার্থনা করেন। এই নামাজ মাসজিদ কিংবা খোলা মাঠেও পড়া যেতে পারে। অন্যান্য নামাজ শুদ্ধ হবার জন্য যে ধর্মীয় শর্তাবলি, এই নামাজেও সেগুলো প্রযোজ্য। এই প্রার্থনার পরে মৃতদেহকে ইসলামী রীতিতে দাফন অর্থাৎ সমাধিস্থ করা হয়। খুব সাধারণ এবং ভাবগম্ভীর একটা ধর্মীয় প্রার্থনা যেটায় সবার মনই কিছুটা ভারাক্রান্ত হওয়া স্বাভাবিক। একজন মানুষ চিরবিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে, এই চিন্তার সাথে সাথে একদিন আমাদেরও এভাবেই চলে যেতে হবে, এই চিন্তা মানুষকে আচ্ছন্ন করে। সেটাই স্বাভাবিক।
আবু দাউদ শরীফের উল্লেখিত একটি হাদিসে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর অমোঘ বাণী বর্ণিত হয়েছে, ‘যখন তোমরা মৃতব্যক্তির জানাজা পড় তখন একাগ্রচিত্তে কায়মনোবাক্যে তার জন্য প্রার্থনা কর’। দুঃখের সাথে বলতে হয়, এই নামাজের ভাবগাম্ভীর্যতা থেকে আমরা মনে হয় অনেকটাই দূরে সরে গেছি আমাদের সামাজিক লোকাচারের কারণে। আমরা নিজেরা নিজেরা এমন কিছু ব্যাপার নিয়ে এসেছি যেগুলা নিতান্তই দুঃখজনক। সম্প্রতি দুইদিন আগে জুমুআর নামাজের পরে ঘোষণা করা হল ‘মোনাজাতের পরে’ জানাজা নামাজ হবে। অথচ, আমাদের দেখা দৃষ্টিতে দেখা যায়, মূল ফরজ নামাজের সমাপ্তির সাথে সাথেই যাদের ব্যস্ততা থাকে তারা উঠে যায়। যথারীতি সেটাই হল। শত শত মানুষ নেমে যাচ্ছিল। আমিও নিজেও চলে যেতাম কিন্তু ‘জানাজা আছে’ এই ঘোষণার কারণে আমি বসে রইলাম। জুমুয়ার নামাজের পরে যে ‘মুনাজাত’ করা হয় সেখানে ইদানিং এতো বেশী ‘লৌকিকতা’র ছড়াছড়ি দেখি যে আমি হাত উঠানো বন্ধ করে দিয়েছি অনেক আগেই।
মুনাজার করার ইচ্ছা হলে আমি নিজেই করি। উল্লেখ্য যে, মুনাজাত মূল নামাজের কোন অংশ নয়। এটা অরিতিক্ত প্রার্থনা যা নিজের স্বীয় ভাষাতেও করা যায়। ইসলামী রীতির বিধানানুসারে মুনাজাত একটা অতিরিক্ত বা ‘নফল’ বা ‘মুস্তাহাব’ পর্যায়ের কাজ। পক্ষান্তরে মৃতের জানাজা পড়া ‘ফরজে কেফায়া’ যা বাধ্যতামূলক নামাজের মধ্যে দ্বিতীয় ধাপের। আমি অত্যন্ত আশাহত হয়েছি যখন শুনেছি, জানাজা হবে মুনাজাতের পরে! ব্যপারটা হল, ‘লাঞ্চ খাওয়া হবে চা খাওয়ার পরে’ টাইপ একটা ব্যাপার। মসজিদে যে জানাজা উপস্থিত সেটা তো ইমাম বা কর্তাব্যক্তিরা আগেই জানতেন। উনাদের কি উচিত ছিল? মূল জুমুআর নামাজ শুরুর আগেই ঘোষণা করে দেয়া যে, জুমার নামাজের পরে আগে জানাজা হবে এবং এরপর দোয়া বা মুনাজাত হবে। সেটাই কি উচিত ছিল না? কিন্তু সেটা হল না। মুনাজাতের মধ্যে শত শত মানুষ মাসজিদ থেকে বের হয়ে গেল। অথচ মূল নামাজের সালাম ফেরানোর সাথে সাথেই যদি ইমাম সাহেব ঘোষণা দিতেন, ‘আমরা সবাই দাঁড়িয়ে যাই, এখন জানাজা হবে’। তাহলে আমার মনে হয় না কেউ বাইরে চলে যেত! সবাই সাথে সাথেই দাঁড়িয়ে যেত জানাজা নামাজের জন্য। কিন্তু আমাদের কর্তাব্যক্তিরা সেটা করলেন না। মুনাজাতের পূর্বে কে কে দোয়া চেয়েছেন, তার বিশদ বিবরণ পড়ে শোনানো হল। কার কি হল জানি না, আমার মন ঘৃণায় বিষিয়ে গেল।
হজ্জের সময় বা বিশ্ব এস্তেমা চলাকালীন অনেক মুসল্লীর মৃত্যু হয়। তাদের জানাজাও এই বিপুল জমায়েতেই করা হয়। এস্তেমার মাঠে আমরা একসাথে একাধিক মুসল্লীর জানাজা একসাথে পড়েছি। পুরুষ মহিলার সম্মিলিত জানাজাও একসাথে পড়েছি। গাজীপুরে বা টঙ্গী এস্তেমার মাঠের আশেপাশের কোন মুসলমানের মৃত্যু হলেও যেহেতু লাখ লাখ মানুষের একত্র উপস্থিতি থাকে সেহেতু সেইসব মৃতদেহকে এস্তেমা মাঠে আনা হয় এবং নিকটবর্তী ওয়াক্তিয়া নামাজের সালাম ফিরানোর সাথে সাথে সবাই জানাজা নামাজ পড়ে ফেলে। মূল নামাজের জন্য যখন মুসল্লিরা দাঁড়িয়ে যায় তখনই মিম্বর থেকে মাইকে ঘোষণা করে দেয় হয়, নামাজের পরে জানাজা আছে। এরপরে মূল নামাজ শেষ হওয়া মাত্রই আবার ঘোষণা করা হয়, ‘ভাই আমরা সবাই দাঁড়িয়ে যাই, জানাজা আছে। একজন বালেগ পুরুষের জানাজা’ অথবা ‘দুইজন বালেগ পুরুষের জানাজা’ এভাবে ঘোষনা করা হয়। ঘোষণাকারী দুই তিন ভাষায় একসাথে ঘোষণা করতে থাকেন। উর্দুতে বলেন, ‘এক বালেগ মরদ কি জানাজা’ আর আরবীতে বলেন, ‘আসসলাতু লির-রজুল’ ব্যস এইটুকুই। এই ফাঁকে মুসল্লীরা মনে মনে তৈরী হয়ে নিতে থাকেন, আর মৃতদেহকেও তখন ইমামের সামনে হাজির করা হয়। মিনিট খানেকের ব্যাপার মাত্র। জানাজার নামাজ শেষ হবার পরে সবাই সুন্নত পড়েন (যদি থাকে) নতুবা বয়ান (ধর্মীয় আলোচনা) শোনার জন্য যে যার জায়গায় বসে যান। এখানে মৃতের কোন নাম, ধাম, পরিচয় কিছুই বলা হয় না। এগুলার কোন প্রয়োজন নেই। থাকলে এস্তেমাতে অবশ্যই সেটা করা হত। হজ্জের মধ্যেও শুধু ঘোষণাই করা হয়। হজ্জেও শুধুমাত্র ‘আসসলাতু লিল-মায়্যীত’ বলেই জানাজা শুরু করে দেয়। সেখানি কি সৌদি বাদশাহ না ঝাড়ুদারের জানাজা পড়া হল কিছুই ঘোষিত হয় না।
আর আমরা আমাদের এলাকার মহল্লায় কি দেখি? লাশ কে সামনে ফেলে কত কাহিনী! জানাজা কিভাবে পড়া হবে সেটার বিষদ বিবরণ, লাশের কোন দেনা পাওনা আছে কিনা সেই ফিরিস্তি! কে মারা গেল, ওমুকের কি হয় ওমুক কি ছিলেন সেগুলোর বিশদ কাহিনী চলতে থাকে। এরপরে সবচেয়ে বেশী আপত্তিকর যে কাজ করা হয় সেটা হল, মৃত মানুষের ব্যাপারে উপস্থিত দের স্বীকারোক্তি! ‘এই মানুষটা কেমন ছিলেন’? সবাই সমস্বরে বলে ‘ভাল’! এমন তিনবার করা হয়, যার সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই! কোন মানুষ কেমন ছিলেন সেটা কি সৃষ্টিকর্তা জানেন না? এমন অনেক অনেক কুপ্রথার ভেতর আমরা নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছি। মানুষ এখন অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে। যাদের মাধ্যমে ধর্ম মানুষের কাছে পৌঁছে তারা কতটা দায়িত্বশীলতার সাথে সেই দায়িত্ব পালন করেন সে ব্যাপারে আমার দ্বিখন্ডিত মতামত রয়েছে। পরবর্তীতে আশাকরি সেগুলো লিখবো।