কারো জন্য মায়া লাগাকে বা মনে কষ্ট লাগাকে বা সোজা কথায় কাউকে Miss করা বোঝাতে আমার দাদী আঞ্চলিক ভাষায় বলতেন ‘পরাণ পোড়া’। আমাকে দেশের বাড়ীতে একবার বেড়াতে গেছিলাম, আম্মু গেছিলো না, আমি গেছিলাম আব্বুর সাথে। এক রাতে আমার কিছুটা মন খারাপ দেখে দাদী বলেছিলেন, ‘মা’র লাইগে পরাণ পুড়তিসে দাদু?’ উনি উনার আঞ্চলিক টানে কথাটা বলেছিলেন, কিন্তু কথাটার মধ্যে কতখানি মায়া আসলেই লুকিয়ে ছিল! কাউকে দেখতে চাওয়ার জন্য মন আকুলি বিকুলি করাই হল ‘পরাণ পোড়া’। আমিও যেহেতু একজন মানুষ, আমারো মন খারাপ হতে পারে, আমারো কারো জন্য পরাণ পুড়তে পারে। আর সেই পরাণ পোড়া থেকে কাউকে, কোন বন্ধুকে, কোন সুহৃদ কে, কোন পরিচিত কে দেখার জন্য মনে মনে অস্থির হয়ে যাই, তার সাথে কথা বলার জন্য হয় নয় কারণ দিয়ে ছুতা খুঁজি। কারণ তো একটাই ‘পরাণ পোড়ে’ যে! কিন্তু এই খারাপ লাগা যার জন্য, সে যদি না বুঝে, তাহলে পরাণটা সেই পোড়া চিঠির মতই হয়ে যায় যেটা তার প্রাপকের কাছে যাবার আগেই পুড়ে ছাই হয়ে গেল। কাগজের ছাই দেখা যায়, পোড়া গন্ধ পাওয়া যায়, কিন্তু পরাণ যখন পোড়ে, সেটা কাউকে বোঝানো যায় না। বেশীর বেশী মনের বা পরাণের যখন বাঁধ মানে না, তখন চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়ে। লোক সেটাকে কান্না বলে। চোখের পানি বলে, কিন্তু পরাণের পোড়াটা কেউ দেখে না। পরাণ পোড়ার জ্বালা কাউকে বোঝানো যায় না।
ছোটবেলায় ৬ বছর বয়সে যখন সৌদি-আরবে ছিলাম, তখন বেশীরভাগ সময়েই বড় খালার বাসায় থাকতাম। খালাতো ভাইটা আমার বয়সী ছিল। খালাতো বোন ছিল, ওদের সাথে আমার সখ্যতা অনেক বেশী ছিল। ওদের সাথে খেলতাম। খাইতাম দাইতাম! ওদের বাসায় গেলে আসতেই চাইতাম না। এই নিয়ে আব্বু মনোক্ষুণ্ণ হলেও কিছু বলতেন না। একদিন বড় খালার বাড়ীতে খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রাত বেশী হয়ে গেছিল দেখে আব্বু আম্মু আমাকে বড় খালাদের বাসার একটা ঘরে শুইয়ে চলে গেলেন। আমাদের বাসাটা হাঁটা পথে গলির এমাথা ওমাথা ছিল। দুই মিনিটের পথ আর কি। মাঝরাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। কিছুটা অন্ধকার ঘরে হাতড়ে হাতড়ে বুঝলাম আমি আমাদের বাসায় না। বিছানা হাতায়ে মনে করেছিলাম আম্মু আছে আমার পাশে। কিছুক্ষণ পরে বুঝতে পেরেছিলাম, আম্মু নাই। সেদিন আম্মুর জন্য আমি যে কিভাবে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে কেঁদেছিলাম আর দেয়ালে ঘুসি মারছিলাম আমার এখনও মনে আছে। আমি কাঁদছিলাম, কারণ ঐ মুহুর্তে আমার আম্মুর জন্য পরান পুড়ছিল।
তখন বাংলাদেশে চলে এসেছি। স্কুলে সিক্সে পড়ি তখন। আমার নানু বেড়াতে এসেছিলেন। নানু যখন আসতেন, নানা রকমের পিঠা আর খাবার নিয়ে আসতেন। নানু আমাদের বাসা থেকে বের হয়ে আমাদের বাসার খুব কাছেই আমার এক মামাতো বোনের বাসায় যাবেন দেখা করতে। খুব কাছে হলেও, বয়সের কারণে কিছুটা শারীরিক দূর্বলতার জন্য উনাকে রিক্সায় তুলে দিলাম। রিক্সায় তখন একাই যেতে পারতেন। নানুকে রিক্সায় তুলে দিয়ে যেই রিক্সা চলে যাওয়া শুরু করলো, আমার আর মন মানলো না। নানুর জন্য ভীষণ কষ্ট হতে লাগলো। উনাকে তো বলতেও পারি না যে ফেরত আসো। রিক্সা চলে কয়েক গজ যেতে না যেতেই আমি রিক্সার পেছনে দৌড়াতে লাগলাম। আমিও উনার পেছন পেছন যাব। পেছন থেকে নানুর বোরকা আর উনার হাতব্যাগের কিছুটা দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি ডাক দেই নি। শুধু পিছে পিছে দৌড়ে গেছি। নানুকে দেখতে তো পাচ্ছিলাম। রিক্সা থামলো, নানু ভাড়া মিটিয়ে আমার মামাতো বোনের বাসায় চলে গেলেন। আমি একটু দূর থেকে দেখলাম। মন কিছুটা শান্ত হল। এরপর আমি আবার হেঁটে হেঁটে বাসায় চলে আসলাম। নানুর রিক্সার পিছে পিছে দৌড়ে গেছিলাম কারণ আমার নানুর জন্য পরাণ পুড়ছিল। আমার চোখের সামনে উনি চলে যাচ্ছেন এটা মেনে নিতে পারছিলাম না। অথচ আইসিইউ তে উনি আমার চোখের সামনেই চিরতরে চলে গিয়েছিলেন। খুব কাছে থাকা সত্ত্বেও আমি দৌড়ে নানুকে আর ধরতে পারিনি। নানু চিরতরে চলে গেলেন। এখনও নানুর জন্য পরাণ পোড়ে আমার। কাউকে কিছু বলতে পারি না।
২০০৯ সালে আমার প্রবাস জীবনের মাত্র দেড় বছর পার হয়েছে। এপ্রিল মাসের ঘটনা। আমার আব্বু আর বোন সিঙ্গাপুরে গেছিলো আমাকে দেখতে। উনাদের লম্বা সফর ছিল। থাইল্যান্ড ঘুরে ফেরার পথে সিঙ্গাপুরে আমাকে দেখতে গেছিলেন। তখন ছিল আমার পরীক্ষার সময়। একদিন আব্বু আর বোন আমার ভার্সিটিতে ঘুরতে আসলেন। উনাদের সাথে ম্যাকডোনাল্ড এর বার্গার খেলাম। মাত্র দুইদিন পরে আমার পলিমার কেমিস্ট্রির পরীক্ষা ছিল প্রফেসর এন ট্যাং ক্যাং এর। ভীষণ ভাল একজন প্রফেসর ছিলেন। অনেক কিছুই পড়তে হবে। উনাদের সাথে গল্প করতে করতে রাত হয়ে যাচ্ছিলো, উনাদের বাস স্ট্যান্ড যেটা আমার ভার্সিটি সংলগ্ন ছিল সেটাটে গিয়ে উনাদের বাসে তুলে দিলাম। উনারা যাবেন আমাদের পরিচিত এক আন্টির বাসায়। উনারা বাংলাদেশী। আমিও উনাদের বাসায় প্রায় যেতাম। আন্টি অনেক আদর আপ্যায়ন করতেন। আব্বু আর বোন রাতে আন্টিদের বাসাতেই থাকবেন। আমি উনাদের কে বিদায় দিয়ে আমার Laboratory তে ফিরে আসলাম যে পড়তে বসবো। দুইদিন পরে পরীক্ষা। আর আব্বুরা একদিন পরে মালেশিয়া হয়ে বাংলাদেশে ফেরত আসবে। ল্যাবে ঢুকে পড়ার কাগজগুলা নিয়ে বসলাম। কিন্তু একি, আমি তো একটা অক্ষরও পড়তে পারছিলাম না। আমার সারা বুক জুড়ে কি এক হাহাকার, আর সে কি শূন্যতা! চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছিল। একটা অক্ষরও পড়তে পারছিলাম না। ঘড়ি দেখলাম। এখনো বাস ট্রেন চলছে। আর কিছুক্ষণ পরে সেটাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। একটা কাপড় আর লেখাপড়ার সরঞ্জাম নিয়ে ছুট লাগালাম বাস স্ট্যান্ডে। আমিও যাব আন্টির বাসায়। বাসায় গেলেই তো আব্বু আর বোনকে দেখতে পাবো। উনারা আন্টির বাসায় খেতে বসেছিলেন। তার ঠিক ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মাথায় আমিও গিয়ে ঢুকলাম। আমাকে দেখেই আব্বু বলেছিল, আসো, বুঝছি তোমার মন টিকে নাই। আন্টি আমাকে খেতে বসিয়ে দিলেন। সেদিনের আমার সেই অনুভুতি আর কিভাবে ছুটে গিয়েছিলাম আমি কাউকে বলে বোঝাতে পারবো না।
মানুষ তো আমিও। আবেগ আমার মধ্যেও কাজ করে। যাদেরকে বা যেসব বন্ধুদের খুব মন দিয়ে Feel করি বা যাদের জন্য আমার অনেক ভাললাগা কাজ করে বা যাদের জন্য আমার পরাণ পোড়ে তাদেরকে আমি আসলে নানা ভাবেই বিরক্ত করে ফেলেছি। অনেকেই হয়ত বিরক্ত হয়েছে, কিন্তু আমি সেটা বুঝিনি। আমি শুধু আমার পরাণ পোড়া থেকে তাদের বারবার দেখতে চেয়েছি, তাদের কাছে যেতে চেয়েছি। আমি আমার অনুভুতিটা আসলে কাউকে বোঝাতে পারিনি। আমার ভুল বা আমার বিচক্ষণতার দোষেই বলতে হবে, আমি তাদের জন্য যতখানি ভেবেছিলাম আমার জন্য তো তারা তেমন ভাবেই নাই। হয়ত আমি তাদের কাছে আসলে বন্ধুই ছিলাম না। নিছক ভদ্রতার খাতিরে মিশেছে হয়ত। আমার ডাকাডাকিতে হয়ত বিরক্ত হয়ে সাড়া দিয়েছে, কিন্তু আমি বুঝিনি আমি তাদের বিরক্ত করেছি। হয়ত আমার উপস্থিতিই তাদের কাম্য ছিল না। যাদের বিরক্তির কারণ হয়েছি, তাদের বলছি, আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন। আমি আসলে বুঝতেই পারিনি যে কারো পরাণ পোড়া অন্যজনকে স্পর্শ নাও করতে পারে। পরাণ শুধু ভেতরে ভেতরে পুড়েই যায়, কাউকে দেখানো যায় না। শুধু ভবিষ্যতে আর কারো বিরক্তির কারণ হতে চাই না। যাদের মন দিয়ে ভালবাসি, যাদের জন্য আমার পরাণ পোড়ে, তারা সবাই ভাল থাকুক।