‘অপেক্ষা’ শব্দটার মধ্যেই কি যেন একটা রয়ে গেছে। অপেক্ষা শুনলেই অনেকে রোমান্টিসিজম অনুভব করেন। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। অন্তত বলতে পারি, ছিলাম। অপেক্ষা শুনলেই একটা অন্যরকম ভাললাগা কাজ করতো। আমাকে কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে ডঃ হুমায়ূন আহমেদের লেখা কোন একটা বই যদি পছন্দের তালিকায় ফেলতে হয় তাহলে আমি বিনা দ্বিধায় বলে দিব উনার ‘অপেক্ষা’ উপন্যাসটা। এই শব্দটার মধ্যেই কেমন যেন শক্তিশালী একটা বার্তা লুকায়িত আছে। অপেক্ষার পেছনে আছে ধৈর্য্য আর কিছু একটা পাওয়ার প্রত্যাশা। শুধু প্রিয়জনের সাথে দেখা করার অপেক্ষাই নয়, মানুষের জীবনে কত হাজার বার কত রকম অপেক্ষার সমাগম ঘটে। কোন কোন অপেক্ষার শেষ মৃত্যু ছাড়া আর কোন কিছুতেই হয় না। সাময়িক যে অপেক্ষা আছে সেগুলোর ফলাফল তো পাওয়াই যায়। কিছু তো আসেই। কোনটা সুখকর আর কোনটা বেদনাদায়ক। তবুও অপেক্ষা থাকবেই। অপেক্ষার উর্ধ্বে কি মহাপুরুষরাও যেতে পেরেছেন? তারাও কি তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে যাবার জন্য অপেক্ষা করেন নি?
অপেক্ষা শুধু একা থাকলে তো হতই। হাসিমুখে সহ্য করা যেত। কিন্তু অপেক্ষার সাথে একসূত্রে গাঁথা থাকে প্রত্যাশা। মানুষ কিছু পাবার আশায় বসে থাকে। আর সেই অজানা জিনিস পাবার প্রত্যাশায় মন আকাশ পাতাল ভাবতে থাকে। দুশ্চিন্তা হতে থাকে। অভীষ্ট জিনিস পেয়ে গেলে আনন্দ, আর না পেলে হতাশার নরককুন্ডে পর্যবসিত। নরক যন্ত্রনা মানুষ পৃথিবীতে পায় কি করে আমি জানি না। কিন্তু বারবার প্রত্যাশা করে বিফল হওয়ার যন্ত্রনা কি কম মনে হয়? যার হয়েছে, বোধকরি সেই শুধু বলতে পারে। সেই ভুক্তভোগীদের তালিকার শীর্ষে আমার নাম লিখে দেয়া যেতে পারে। নিজেকে অহেতুক প্রতীক্ষার পর্বে ফেলেছি, আর সেখান থেকে ব্যর্থ মনোরথ হয়েছি। প্রতীক্ষার পরে ব্যর্থ মনোরথ, কেউ যদি এটা মনে রেখে নিজেকে সরিয়ে ফেলতে পারে তাহলে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আমি বারবার একই ভুলে পা বাড়িয়েছি। প্রতিবার নিজেকে তিরস্কার করেছি, আর করবো না এমন! তবুও নিজের জন্য গর্ত খুড়েছি আর স্বেচ্ছায় ঝাপ দিয়েছি সেখানে।
অপেক্ষার মাত্রা যে কত প্রবল থেকে প্রবলতর হতে পারে সেটা টের পেতাম প্রবাস জীবনে। ঘরে ফেরার জন্য কি এক অদম্য অপেক্ষা কাজ করতো মনের ভেতরে। একেকটা করে দিন গুনতাম। ঘড়ি দেখতাম। ক্যালেন্ডারে দাগ দিতাম। কবে আসবে সেই সময়। অপেক্ষার সময়গুলো যেন ফুরোতেই চাইতো না। শপিং মলে গিয়ে গিয়ে নানা জনের মুখ কল্পনা করেছি আর এটা ওটা কিনেছি। মনে মনে কল্পনা করেছি, এটা পেলে সে কেমন খুশী হবে, কি বলবে না বলবে সেটা ভেবে। সেগুলো চিন্তা করে করেই দিন কাটতো। দোকান থেকে কেনা জিনিসগুলো বারবার নেড়ে চেড়ে দেখতাম আর ভাবতাম, কত খুশী হবে তাই না? ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়তাম। কিন্তু বাস্তব এই কল্পনার মত হয় কখনও? হয় না। এক্ষেত্রেও হবে কেন? যা কল্পনা করেছিলাম তার কিয়দংশ হয়ত মিলেছে, বেশীরভাগই এমন ফলাফল পেয়েছি যেটা কল্পনাতেও ছিল না। মনে চোট লেগেছে। কষ্ট করে আনা উপহার যাকে দিলাম সে যদি ব্যবহারই না করলো, অথবা বলে দিল আমি তো এই জিনিস ব্যবজার করি না, কিংবা রাগের মাথায় ছুড়ে ফেলে দিল, তখন যে মনের ভেতর কেমন লাগে সেটা লিখে বোঝানো যাবে না।
আমি ছোটবেলা থেকেই চকলেট খেতে ভীষণ পছন্দ করতাম। এখনও করি। কিন্তু আমার ভেতর অদ্ভুত একটা চিন্তা কাজ করে। আমি নিজের জন্য চকলেট কখনোই কিনে খাই নি। কিনিও না। প্রবাস জীবনে আমি হাজার হাজার টাকার চকলেট কিনেছি, সবই মানুষের জন্য। বিশ্বাস করুণ আমি একটা টুকরাও মুখে দিয়ে দেখিনি। ইচ্ছে করতো না। বরং সেই সব মুখগুলো চিন্তা করতাম, যাদের জন্য চকলেটগুলো কিনতাম। আমাকে যদি কেউ চকলেট দেয়, তাহলেই শুধু আমি খাই। এর অন্যথা কখনো হয় না। আমি কিনে অন্যকে দিব কিন্তু নিজে খাবো না। ভাবছেন এখানে অপেক্ষা কিভাবে হল? শুনুন তবে। আমি প্রথমবার যখন প্রবাসে পাড়ি জমাই, আমার সাথে আব্বু আর খালাত ভাই গিয়েছিল। আব্বু যখন আমাকে রেখে চলে আসবেন, তখন আমাকে Snickers চকলেটের একটা বার আমার হাতে দিয়ে বলেছিল, তুমি খেও। আমি ডীপ ফ্রিজে চকলেট টা ৩ মাসের মত তুলে রেখেছিলাম। ফ্রিজ খুলতাম, আর দেখতাম। খেয়ে ফেলতাম না। ভাবলাম খেলে তো হয়েই গেল। থাক না। আব্বুর দিয়ে আসা স্মৃতি। চকলেটটা দেখতাম আর বাসার কথা মনে পড়তো। অপেক্ষা করতাম আমি কখন বাসায় যাবো।
আমার কিছু কিছু বদ অভ্যাস আমি ত্যাগ করতে পারলাম না। কেন যে পারলাম না নিজেও জানি না। চেষ্টা তো কম করছি না। অপেক্ষা করার বদ অভ্যাস! কি হয় অপেক্ষা করে? দরকার কি? একটু একটু করে যখন জেনেই যাচ্ছি, কেউ তো আসলে কারো জন্য হয় না, সবাই বাঁচে তার নিজের জন্য, তাহলে অপেক্ষা করবোই বা কার জন্য। ভাললাগা, ভালবাসা, মায়া এই জিনিসগুলাই মনে হয় জীবনের অগ্রসর হবার সবচেয়ে বড় পিছুটান হিসেবে কাজ করে। এই বাঁধা অতিক্রম করতে না পারলে সামনে অগ্রসর হওয়া যায় কি? আপনারা ভাববেন না আমি আপনাদের কথা বলছি। না আমি আমার নিজের কথাই বলছি।
প্রবাস জীবনে প্রথমে যেই ডরমিটরিতে ছিলাম, সেখানে আমারই ভার্সিটিতে পড়া আরো তিনজনের সাথে একসাথে উঠেছিলাম। ছয়মাস একসাথে ছিলাম। সবাই ডরমিটরি থেকে অন্য জায়গায় বাসা খুঁজে চলে যায়। আমি কি এক ভুলের স্বর্গে বাস করে অপেক্ষা করছিলাম। আমি ভেবেছিলাম, আমরা এই চারজনই একসাথে অন্য কোথাও বাসা নিয়ে চলে যাব। ওরা কোথায় যাবে অন্তত আমাকে তো বলবেই। কিন্তু একদম শেষ বেলায়, আমার ভুল ভেঙ্গেছিল। ওরা যে যার মত বাসা খুঁজে নিয়েছিল। শুধু আমিই বোকামী করে কোন বাসা খুঁজিনি। পরে যখন ওদের কাছে জানতে পারলাম ওরা যে যার মত বাসা খুঁজে নিয়েছে, আমি নিজেকে পুরষ্কার হিসেবে তিরষ্কার করা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারিনি। ওরা বাসা খুঁজে নিয়েছে অথচ আমি কেন খুজলাম না। নীচু গলায় শুধু বলেছিলাম, অন্য কোন বাসার সন্ধান যদি পাও আমাকে জানাইও। ফলাফল হিসেবে আমি আরো এক সেমিস্টার সেই ডরমিটরিতে ছিলাম নতুন দু’জন ইন্ডিয়ান ছাত্রের সাথে। আমার সেই এক সেমিস্টারের অপেক্ষা আমাকে নতুন করে শিক্ষা দিয়েছিল। ‘অপেক্ষা’ আমাকে শিখিয়েছি, কারো জন্য ‘অপেক্ষা’ করো না, নিজের আশ্রয় নিজেই খুঁজে নাও। আমি সেই শিক্ষা মনে রেখেছি।
আগে চিঠিপত্র যখন লিখতাম, তখন কি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। আমার চিঠিটা কি গেল? কবে আসবে তার উত্তর? অদ্ভুত এক শিহরণ কাজ করতো মনের ভেতর। চিঠি যেত, চিঠি পেতাম। ভাললাগা কাজ করতো। সারা দিন আনন্দে মন ভরে থাকতো। এখন তো যুগ পালটে গেছে। এখন কেউ চিঠি লেখে না। এখন অত্যাধুনিক পদ্ধতি আছে। টেক্সট মেসেজ, ম্যাসেঞ্জার আরো কত কি! মূহুর্তের মধ্যে যোগাযোগ, ভিডিও কল আরো কত কি! ঐ পক্ষ দেখলো কি না দেখলো মেসেজ, সেটাও মোবাইল হাতে নিয়ে দেখা যাচ্ছে। তবুও কি আমার অপেক্ষা শেষ হয়েছে? বন্ধুদের সাথে কথা বলার জন্য, ভাললাগার মানুষগুলোর একটু উত্তরের জন্য কি অখন্ড অপেক্ষা করেছি। কত কত প্রশ্ন করেছি, কত কিছু বলেছি! কিন্তু যখন দেখেছি, ওপারে আমার প্রিয় মানুষ, আমার বন্ধু, সুহৃদ বা যেই হোক না কেন, আমার পাঠানো মেসেজ দেখেছে। দেখে রেখে দিয়েছে। আমার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার কোন দরকার মনে করেনি, তখন? আমি বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছি। কিন্তু অভ্যাসের বসে আবার ঘুরে ঘুরে গিয়েছি সেই বন্ধুর সাথে চ্যাট বক্সে, উত্তর দিল কি? উত্তর দিবে না? আবার প্রশ্ন করেছি, প্রশ্নবোধদ চিহ্ন দিয়েছি, তাগাদা দিয়েছি উত্তর দেয়ার জন্য। কখনও উত্তর পেয়েছি কখনও ব্যর্থ মনোরথ হয়েছি। যদি এমন হত ওপারের মানুষটা আমার লেখা দেখেই নাই, তাহলেও মনকে প্রবোধ দিতে পারতাম। কিন্তু হয় তার বিপরীত। আমার ভালবাসা বা আমার ভাললাগাটা হয়ত তার কাছে আমার দূর্বলতা হয়ে ধরা দিয়েছে। যে ভাললাগা নিয়ে আমি কিছু লিখেছি, সে ভাললাগা তার ভেতরে হয়তো কাজ করেই নি! তবুও আমি অপেক্ষা করেছি। অপেক্ষা করতে ভাল লেগেছিল, হয়ত উত্তর আসবে। কালেভদ্রে আসে। কিন্তু নিতান্তই দায়সারা গোছের। সেই দায়সারা উত্তরটাই আমি উলটে পালটে কতভাবে দেখেছি। স্ক্রল করে পেছনে গিয়ে গিয়ে পড়েছি। মিথ্যে করে নিজেকে বোঝাতাম, পেছনের মেসেজ দেখতে দেখতে হয়তো বন্ধুর বা প্রিয় মানুষটার আরো মেসেজ আসবে। আসে না। বেশীরভাগ সময়ই আসে না। এটাই হয়তো নিয়ম। আমি নিয়ম মানিনি। শাস্তি তো আমার প্রাপ্য।
নিজেকে শোধরাবার চেষ্টা করছি। অপেক্ষার মধ্যে কোন রোমান্টিসিজম আছে সেই কথা আমি মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছি। সফল হয়েছি কিছুটা। আমার মেসেঞ্জার থেকে পরিচিত অপরিচিত সবার সব মেসেজ আমি মুছে ফেলেছি। পেছনে কি লিখেছে বা আমি কি লিখেছি, সেগুলো আমার আর দেখার দরকার নেই। কে আমাকে কি উত্তর দিল বা না দিল তাতে আমার এখন আর কিছু যায় আসে না। যে পিছুটান এক তরফা ভাবে মনকে চিরে টুকরো টুকরো করে দেয়, কি দরকার সেই পিছুটানের? সবার কাছ থেকে, আমার সেই সব প্রিয় মানুষগুলোর কাছ থেকে আমি শিখে নিয়েছি, সময় শুধু এগিয়ে যাওয়ার। ভাললাগা দিয়ে জীবন ভরবে না। একতরফা আবেগে আর ভাললাগায় ‘অপেক্ষা’ নামক অভিশাপটাই কাজ করে। অপেক্ষা একতরফা ভাবেই মনকে, আত্মাকে পৌনঃপুনিক ভাবে নিঃশেষ করে দেয়।