সম্পর্কগুলো কি সারাজীবন একই থাকে? সম্পর্কের ভেতর কি টানা পোড়েন আসে না? আমি তো আজ পর্যন্ত দেখিনি কোন সম্পর্ক একই রকম অটুট থাকে। প্রতিনিয়ত এর ভেতর আসতে থাকে ভাঙ্গা গড়ার খেলা। কত রূপে কত বৈচিত্রে তা আবির্ভুত হতে থাকে প্রতিনিয়ত আমাদের সামনে। আমরা খুব সহজেই একটা কথা বলে পার পেতে চাই, তা হল মানুষ তো ভুলের উর্ধ্বে না। মানুষ তো ভুল করবেই। এটা যদিও একটা স্বতঃসিদ্ধ কথা যে মানুষ মাত্রই ভুল করে। কেউ বেশী করে, কেউ কম করে, আর কেউ বারবার করে। প্রতিবার ভুল করে আর প্রতিজ্ঞা করে, এই শেষ, আর নয়। কিন্তু তারপরেও শিক্ষা হয় কি? একই ভুল কি মানুষ বার বার করে না? ভুল করা হয়ে গেলে কি আবার নিজেকে দোষারোপ করে না? কেন করলাম এই কাজ? কি হত না করলে? সম্পর্কের উত্থান পতন এর রোষ কেউ সামাল দিতে পারে, কেউ পারে না। কেউ দেরীতে উপলব্ধি করে আর কেউ দ্রুত বুঝে যায়। এখক্ষণ যা যা লিখেছি, সবকিছুর মধ্যেই আমি আছি আমি সবগুলোরই পিছিয়ে পড়ার দলে। আমি বারবার ভুল করি, এবং সেগুলার খেসারত দিতে থাকি একা একাই। হাজারবার প্রতিজ্ঞা করেও রাখতে পারিনি। যে নিজের কাছে করা প্রতিজ্ঞা নিজেই রাখতে পারে না, তার ভুল কে শোধরাবে?
সম্পর্কের উত্থান পতনের মাত্রা একটু চোখ কান খোলা রাখলেই দেখা যায়। যার জন্য আমার মন প্রাণ দিয়ে দিচ্ছি, অথবা যাকে মনে প্রাণে এত Miss করছি, যাকে দেখার জন্য মন উতলা হয়ে যাচ্ছে- কই তার মধ্যে তো কোন ভাবান্তর হচ্ছে না! সে তো আমার জন্য তার কিয়দংশও বোধ করছে না যা আমি তার জন্য করছিলাম। সবকিছু কি একতরফা হয়ে গেল না? আপনারা আমার সাথে একমত হবেন কিনা জানিনা, হয়তো আপনাদের ক্ষেত্রে এমন হয় না, না হোক আমিও সেটাই চাই। আমি আমার জীবনে আমার আশপাশে যত সম্পর্ক দেখেছি, তার সবগুলোই তো একতরফাই পেলাম। যে আশা নিয়ে বসে ছিলাম, তার কিয়দংশও তো কোনদিন পূরণ হয়নি। মাঝে মাঝে আমার মনে প্রশ্ন আসে, সম্পর্ক আসলে কি? ভাললাগা বা কাউকে Miss করা এই ব্যাপারটাই বা আসলে কি? Miss করা ব্যাপারটার কোন যোগ্য সমার্থক বাংলা শব্দ আমার চোখে পড়েনি। নানা ভাবে চিন্তা করে আমি আমার মত করে Miss করার ব্যাপারটার একটা মানে দাঁড় করিয়েছি। এটা শুধু নিছকই আমার নিজের কল্পনা, সেটা হল যে সামনে নেই, তাকে দেখতে পাবার জন্য মনের যে প্রবল ব্যাকুলতা সেটাই মনে হয় তাকে miss করা। আমার সেটাই বারবার মনে হয়েছে। আমি আমার প্রিয় কিছু মানুষকে যদিও বা বলেছি, তোমাকে অনেক মিস করছি, বা দোস্ত তোকে অনেক মিস করছি, বেশীরভাগ সময়ই আমার কথা প্রতিধ্বনি হয়ে আমার কাছে ফিরে এসেছে। ফলাফল শূন্য। ভাগশেষও শূন্য। আমার অস্তিত্ত্বও সেই শূন্যেই পর্যবসিত হয়েছে।
আমার কাউকে ভাল লাগলে আমি অকপটে তাকে বলে দেই। সে যেই হোক না কেন। বন্ধু, বান্ধবী, আত্মীয়, অনাত্মীয় সবাই। সম্পর্কের মধ্যে আমি কোন আলাদা গন্ডি রচনা প্রথমেই করে ফেলি না। একেক জনের প্রকাশভঙ্গি একেক রকম হতে পারে কিন্তু আমার কথার প্রত্যুত্তর বোঝার মত বয়স আর অভিজ্ঞতা কিছুটা হলেও আমার আছে। আমি যার উত্তর পাবার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি, সে যদি আমার কথার সামান্যতম সাড়াও না দেয়, সেটা বোঝা কি খুব বেশী দুষ্কর কিছু? আমার ভার্সিটিতে পড়ার দিনগুলোতে, তিন বছরের বেশী সময়, ৬ সেমিস্টার আমার এক বন্ধুর সাথে অনেক সখ্যতা হয়েছিল। এমন কোন বিষয় নেই যেটা নিয়ে তার সাথে আলাপ হত না। প্রতিটা বিষয় আমরা একসাথেই পড়তাম। অবধারিত ভাবেই আমি ধরে নিয়েছিলাম কোর্সের শেষের কাজগুলাও ওর সাথে এক গ্রুপেই করবো। কিন্তু ঐযে কথা বলে না, বিধি বাম! আমার সেই আশা খারাপ ভাবে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আমার সেই বন্ধুর সাথে তৃতীয় বর্ষের শেষভাগেই সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। কারণ সে তার ব্যক্তিগত প্রেম বা ভাললাগার জন্য বন্ধুত্বকে চোখের পলকে উড়িয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করেনি। আমার প্রচন্ড আঘাত লেগেছিল মনে। কিন্তু মরে তো আর যাই নি। খারাপ লাগা কাজ করতো, এখনও করে, কিন্তু এরপরেও বেঁচে তো আছি। পার্থিব জগতে বেঁচে থাকাটাই মনে হয় সবচেয়ে প্রতিকূল কাজ হয়ে যায় সময়ে সময়ে। স্রোতের বিপরীতে সাঁতার দিতে দিতে হলেও বেঁচে থাকতে হবে। স্থবিরতা মানেই নিশ্চিত মৃত্যু।
কিন্তু এরপরেও কি আমার শিক্ষা হয়েছে? হয়নি তো। বারবার হেরে যাচ্ছি নিজের কাছে। তবুও কেমন যেন কূপমন্ডুকের মতই লাগে। হ্যাচড়ে প্যাচড়ে বার বার বের হতে গিয়েও আবার সেই কূপের মধ্যেও পিছলে পড়ে যাচ্ছি। শক্ত অবলম্বন মনে করে যে পাথরে পা রাখছি, সেই পাথরে যে জমে আছে সহস্রাব্দের পিচ্ছিল শেওলা, সেটা আমার স্বপ্নালু দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না। পাথরে আমার ঠাই হয় না, আমি শেওলায় পা পিছলে পড়ে রক্তাক্ত হই। নিজের রক্তক্ষরণ দেখি, আর নিজেকে সান্ত্বনা দেই, রক্তই তো! বেঁচে যদি থাকি, আবার রক্ত তৈরী হবে। রক্তে আবার রয়ে যায় কিছু ভালবাসার বীজ। সগুলো আবার অঙ্কুরিত হতে শুরু করে, কারণ আমি যে এখনও রক্ত মাংসের মানুষ। এখনও নিঃশ্বাস বাকী আছে যে। এর নামই মনে হয় সম্পর্কের বেড়াজালে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকা।
যদি ধরি গড় আয়ু পরিমাণ ও বেঁচে থাকবো, তাহলেও বলতে হয় অর্ধেকের বেশী পার করে ফেলেছি। অনেক কিছু দেখেও মনে হয় আমি আসল শিক্ষা নিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছি। এখনও আমি কোন মুখে মানুষের দিকে আশায় আশায় তাকিয়ে থাকি? আত্মীয়, বন্ধু? কার কাছে কিসের আশায়? কেন এখনও আমার মধ্যে ভাললাগা কাজ করে? করা উচিত নয়। কখনই উচিত নয়। কিন্তু এখন মনে হয় আমার পায়ের তলাতেই নিত্য নতুন শেওলা গজাচ্ছে। যেদিকেই পা দিচ্ছি সেদিকেই পিছলে পড়ে যাচ্ছি। আশ্রয়ের আশায় যেদিকেই হাত বাড়াচ্ছি, সেদিক থেকেই মধুমাখা কত সম্পর্কের ছুরি আমার হাতের বন্ধন কেটে দিচ্ছে। যে অমানিশায় ছিলাম, আবার সেই অমানিশার ঘোর থেকে ঘোরতর অন্ধকারে আমি নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে যেন আমি এক অন্ধকারের দুষ্টচক্রে পতিত। এ থেকে আমার কোন মুক্তি নেই। আমি একাধারে যেমন যুক্তিহীন, তেমনই মুক্তিহীন। কেন যেন আমি মনকে প্রবোধ দিতে পারি না, সবাই সবার মত। আমি যেমন সবাইকে আপন ভাবতে ভালবাসি, কেউ আমাকে আপন ভাবতে পারে না। তাদের সেই সময় আর মন আমার জন্য নেই। যাদের দিকে চাতক পাখির মত তাকিয়ে থাকি, যখন দেখি তারা অন্য সবকিছুতেই নিমগ্ন, অন্য সবার জন্য তাদের সরব উপস্থিতি, কিন্তু আমি সবসময় অনুপস্থিত। আমার ব্যকুলতা তাদের কোনভাবেই স্পর্শ করেনি। আমি যাদের বন্ধু ভাবতে ভালবেসেছিলাম, আমি যখন দেখি তাদের অন্য বন্ধু আছে, সেখানে তারা ভাল আছে, তাদের বন্ধুত্বের তালিকায় আমি নেই, তখন আমি বুঝে যাই, আমার বানানো বন্ধুত্বের অলীক স্বর্গ, মরীচিকা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। যত সামনে এগিয়ে যাই, স্বপ্ন আর আমার ভাললাগা, বন্ধুত্ব সবকিছুই চুরচুর করে ভেঙ্গে যায়। ভাঙ্গা কাচের মত। আমার শেওলা ধরা পা, আবার পিছলে পড়ে, ভাঙ্গা কাঁচরূপী মনে পা কেটে রক্তাক্ত হয়ে যায়। আমি ক্ষতবিক্ষত অন্তরাত্মা নিয়ে উঠে দাঁড়াই, নিজেকে সান্ত্বনা দেই, রক্তই তো! আবার তৈরি হবে।