Vogue শব্দটার সাথে আমি পরিচিত হই ১৯৯৭ সালের দিকে যখন ক্লাস নাইনে পড়ি। তখন ইন্টারনেট এর নাম গন্ধও শুনিনি আর মোবাইল ফোনের তো কোন প্রশ্নই আসে না। অভিধান বা Dictionary খুলে এর মানে দেখলাম Style, Fashion ইত্যাদি। এখনকার আধুনিক যুগে যাদের হাতে স্মার্ট ফোন আছে, তাদের কারো আর অভিধান খুলে শব্দের মানে দেখার দরকার হয় বলে মনে হয় না। বিশাল ভারী এই উপকারী গ্রন্থটি বিদায় নিচ্ছে বা নিয়েছে প্রায় বলা চলে। যা হোক, Vogue শব্দটার মধ্যে কি যেন একটা আকর্ষণ ছিল যা আমাকে আলোড়িত করতো। আমার এক কাজিন আপা Madonna এর গানের ভক্ত ছিল। উনার কাছ থেকে আমি এই গায়িকার গান সম্পর্কে জানতে পারি। ১৯৯৭ সাল থেকেই আমার ইংলিশ গান শোনার হাতেখড়ি। শুরুতে মোটামুটি যা পেতাম তাই শুনতাম। ইংলিশ গান বলে কথা! একটা ভাব আছে না? তখন সেই ক্যাসেটের যুগে, ৩৫ টাকা নিত একটা ইংলিশ ক্যাসেট (পাইরেটেড) এর দাম। টাকা জমায়ে জমায়ে তাই কিনতাম। আমার ঐ আপার কাছে অনেক ইংলিশ ক্যাসেট ছিল। উনার কাছ থেকে নিয়ে শুনতাম। তখন থেকেই আমি Madonna এর গানের ভক্ত ছিলাম। উনার একটা ক্যাসেট ছিল Madonna Greatest Hits সেখানে আমি প্রথমে দেখি Vogue নামেও একটা গান আছে। মহা উৎসাহে শুনলাম vogue গানটা। প্রথমেই শুরু হল, Strike a pose … দিয়ে। নড়েচড়ে বসলাম। এরপরে ফ্যাসফ্যাস করে বললো, Vogue…. Vogue…. সবকিছুই মজা লাগছিল! তখনকার দিনে যেহেতু YouTube এর নাম নিশানাও ছিল না, ইংলিশ গান দেখা বা মিউজিক ভিডিও দেখার মূল উৎস ছিল MTV নামক টিভি চ্যানেলটা। ইন্ডিয়া থেকে যে MTV টেলিকাস্ট হল সেখানে বিকালে দেখানো হত MTV Most Wanted বা অনুরোধের গানের আসর। যেখানে ভিডিও জকি গুলা নানা রকম আল্লাং-ফাল্লাং ভাষা, পোষাক আর ঢং করে করে এক একটা অনুরোধ পড়তো আর সেগুলা টেলিকাস্ট করতো। মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখতাম সেসব।
আমার সেই কাজিন বললো, তুমি Vogue গানটার ভিডিও দেখসো? আমি বললাম, না তো। উনি বললেন উনি এই গানের ভিডিও দেখেছেন সৌদি আরবে থাকতেই। সাদা-কালো ভিডিও আর অন্যরকম। গানে কয়েকটা ছেলে কোট-প্যান্ট পরে নাচে। শুনে আমার হিংসায় গা জ্বলে গেল। একে তো নয়া নয়া Madonna এর ভক্ত তার উপরে উনি Vogue গানটার ভিডিও দেখে ফেলেছে যেটা আমি দেখিনি! একদিন কাকতালীয় ভাবে সেই সুযোগ এসে গেল। MTV Most Wanted এ Vogue গানটার অনুরোধ এল। ওরা টেলিকাস্ট করলো। মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখলাম সেই সাদাকালো ভিডিও আর কোট-প্যান্ট পরা নাচ! যেই মুগ্ধতা নিয়ে তখন দেখেছিলাম, ঠিক সেই মুগ্ধতা নিয়ে এখনও Vogue এর মিউজিক ভিডিও দেখি YouTube এ। দেখলাম, Madonna এর এই গানটার ভিউ সবচেয়ে বেশী। Vogue গানটা Madonna যতগুলা লাইভ প্রোগ্রাম এ গেয়েছেন, তার কোনটাই আমি বাদ দেইনি। এখনও ভাললাগা কাজ করে। অন্য আরো কত গানের মিউজিক ভিডিও থাকতেও Vogue এর উপরে আমার এই আকর্ষণ কেন, সেই ব্যাখ্যা আমার জানা নেই। তখন জানতে পেরেছিলাম, Vogue নামে দামী একটা ম্যাগাজিনও নাকি আছে। নিউ মার্কেট বা অন্য কোথাও দেখেছিলাম একটা সংখ্যা। কিন্তু তখনকার দিনে এই Fashion Magazine কেনার সামর্থ্য আমার ছিল না। কাজেই দূর থেকে দেখাই হত শুধু! আর মনে হত, আহা আমার যদি একটা Vogue ম্যাগাজিনটা থাকতো!
১৯৯৯ সালের শেষের দিকের কথা। মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে পড়ছি। ফুফাতো বোন পুষ্প আপু দুলাভাই দেশে আসবেন, সাথে উনার এক আমেরিকান শিক্ষক Ms Vanessa Dehney ও বেড়াতে আসবেন বাংলাদেশে। আমার বড়ফুফু মহা উৎসাহে কয়েক মাস ধরে তার একটা ফ্ল্যাট রেডী করলেন তার অনাগত এই মার্কিনি অতিথিকে রাখবেন বলে। আত্মীয় স্বজনের মধ্যে সে কি জল্পনা কল্পনা, কেমন হবে এই অতিথি, কি খাবেন কি করবেন! অবশেষে জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অতিথি এলেন। আমরা সবাই দেখতে গেলাম। উনার সাথে বেশীরভাগ কথারই অনুবাদের দায়িত্ব পুষ্প আপুকেই নিতে হচ্ছিল। উনার চোস্ত মার্কিনি ইংরেজী সবার বোধগম্য হচ্ছিল না। সেই Vanessa মিসের সাথে আমি খাতির করে ফেললাম। আর যেহেতু কাজ চালানোর মত ইংলিশে কথা তো বলতেই পারতাম, উনিও আমার সাথে কথা বলে মজা পাচ্ছিলেন। উনার সাথে কত কিছু নিয়ে আলাপ হল। আমি কি কি পড়তে পছন্দ করি সেগুলাও সব উনি খুটায়ে খুটায়ে জেনে নিলেন। আমার কাছে এক ফাঁকে জানতে চাইলেন, আমি ইংলিশ এ এমন কথা বলা কোথায় শিখেছি?
ফুফুর বাসায় অনেক রকম ম্যাগাজিন থাকতো উনার ড্রইং রুমে। আমি একটা উলটে পালটে দেখছিলাম দেখে মিস Vanessa আমাকে বললেন, তুমি ম্যাগাজিন পড়তে পছন্দ কর? তখন আমি বললাম, জ্বি করি। কথায় কথায় Vogue ম্যাগাজিন এর কথাও বের হয়ে আসলো। সবকিছু শুনে মিস Vanessa আমাকে বললেন, উনার আমেরিকার বাসায় অনেক ম্যাগাজিন পড়ে আছে, আর এর মধ্যে Vogue ও আছে। উনি আমেরিকা ফেরত গিয়েই আমার জন্য ম্যাগাজিন পার্সেল করে পাঠিয়ে দেবেন। আমি শুনে কিছুটা অবাক হলাম। ভাবলাম উনি কি আসলেই পাঠাবেন? মনে থাকে কি না থাকে! আমাকে এও জানালেন, Vogue ম্যাগাজিন তো কিছুটা বড়দের ম্যাগাজিন, তাই উনি খুঁজে দেখবেন মোটামুটি কোনটা আমাকে দেয়া চলে, সেটাই পাঠাবেন।
উনারা উনাদের সফর শেষ করে চলে ফেলেন আমেরিকায়। আমিও কলেজের লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। তখন কলেজের ফার্স্ট টার্ম পরীক্ষা চলছিল। ফুফু ফোন দিয়ে জানালো, তোমার একটা পার্সেল আসছে, Vanessa পাঠিয়েছে। আমার আর বুঝতে বাকী রইলো না, উনি উনার প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। ফুফুর শান্তিবাগের বাসায় গিয়ে দেখলাম DHL এ করে এক কার্টনে ভরে বেশ অনেকগুলা ম্যাগাজিন মিস Vanessa আমার জন্য পাঠিয়েছেন অনেকগুলো ডলার খরচ করে। আতিপাতি করে খুঁজে তার মধ্যে পেয়েও গেলাম আমার বহু কাঙ্খিত Vogue ম্যাগাজিন! ইয়া মোটাসোটা একটা সংখ্যা। কত রকমের অ্যাড যে আছে তার মধ্যে। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উলটে চললাম। পারফিউমের পৃষ্ঠাগুলার শেষ মাথায় দেখলাম বর্ডার ভাঁজ করা আর কাগজটা কেমন যেন মোটা লাগছে। এই রহস্য বুঝলাম না! পরে রহস্যের জট খুলে দিয়েছিল খালাতো ভাই। ও একটা মোটা কাগজের ভাঁজ খুলে বললো, শুঁকে দেখ! শুঁকেই আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম! আহা কি সুন্দর পারফিউমের গন্ধ! খালাত ভাই বললো, এইসব ম্যাগাজিনে, যে পারফিউমের বিজ্ঞাপন দেয়, কাগজের ভাজে তার একটু স্যাম্পল মাখিয়ে দিয়ে দেয়! আমার বিস্ময়ের সীমা রইলো না! কত কত ম্যাগাজিন দেখেছি কিন্তু Vogue ম্যাগাজিন এর এই কাহিনী কোনদিও শুনিও নাই জানতামও না। সেদিন থেকে Vogue ম্যাগাজিনের উপরে আমার ভালবাসা আরো বেড়ে গেল। আফসোসের বিষয় হল, আমার কালেকশনে এখন একটাও Vogue নাই। দেখি, সুযোগ পেলে দুই একটা কিনে রাখবো আমার ছোটবেলার স্মৃতিময় সেই Vogue !