ছোট থেকে বড় হওয়াই কিন্তু জীবনের প্রাকৃতিক রীতি। পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীকেই ছোট থেকে বড় হয়ে হয়েছে। এটা তো না হয় দেহগত ভাবে বোঝা গেল। কিন্তু যদি সামাজিক মান মর্যাদার কথাও বলা হয়, অথবা পেশাগত সৌকর্যের কথাই বলা হয়, তাহলেও কিন্তু আপনারা হয়ত একমত হবেন, সেখানেও ছোট থেকেই শুরু করতে হয়। এক লাফে গাছের মগডালে উঠতে চাইলে উপরে উঠার চাইতে পা হড়কে অঙ্গহানি হবার সম্ভাবনাই প্রবল। প্ররিশ্রম, ধৈর্য্য, অধ্যবসয়, মেধা সবকিছুর সমন্বয় না হলে জীবনে উপরে ওঠা যায় না। আমাদের আশেপাশের অনেক মানুষকেই দেখা যায়, নিজেরা উপরে ওঠার পরে, কেমন যেন পেছনের ইতিহাস ভুলে যায়! এমনভাবে তার থেকে নীচের মানুষগুলোর দিকে তাকায় যেন এরা কোন অচ্ছুৎ বর্গের কিছু! অথবা, এই শ্রেনীর মানুষগুলোও যে পরিশ্রম করছে, হয়ত তারাও একদিন উপরে উঠে যেতে পারে, সেটা মনে হয় তাদের মনেই থাকে না। আবার এমন কতগুলো মানুষও দেখেছি, যারা তাদের চেয়ে কেউ যদি উপরে উঠে যায়, তাহলে তাদেরকে হিংসা করে। তাদেরকে হেয় চোখে দেখে। সুযোগ পেলেই তাদের ক্ষতি করার চেষ্টা করে। নিজের অবস্থান ভুলে গিয়ে কোন মানুষ যখন অন্য কাউকে হেয় করার চেষ্টা করে তখন সেটা কতখানি হাস্যকর হয়ে যায় বলতে পারেন? নিছক একটা উদাহরণ দিয়েই বলি, বাড়ীর ছোট-বৌ শশুরবাড়ীতে দাঁড়িয়ে যদি তার ভাসুরকে বলতে থাকে ক্রমাগত, ‘আপনি কে? আপনি কে?’ তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো? এই প্রশ্নের জবাব কি হতে পারে?
আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, অন্যের ক্ষতি করে কিংবা অন্যকে হেয় করে কি নিজে বড়ো হওয়া যায়? অন্যকে বাজে কথা বলে নিজে বড় কিভাবে হয়? প্রশ্নটা আমি সেইসব ধর্মগুরু এবং ধার্মিক(!) মানুষের কাছেও রাখলাম, যারা নিজেদের ধর্মকে ভাল প্রতিপন্ন করার জন্য অন্যের ধর্মকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার জন্য জীবন প্রায় উৎসর্গ করে ফেলেছেন তাদের কাছে। আমি সেই সব ধর্মগুরুর বক্তব্য শুনি না, বা শোনার প্রয়োজনও মনে করি না, যারা মানুষকে মানুষ নয়, বরং ধর্ম দিয়ে বিচার করে আর নিজের বক্তব্যের মধ্যের স্বীয় ধর্মের মহিমা বা আলোচনা না ফুটিয়ে তুলে অন্যের ধর্মের শ্রাদ্ধ করা হয়। যেখানে মানুষকে হেয় করা হয়, সেসব বক্তব্য আমি ঘৃণা করি। মানুষের জন্য ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ না। মানুষ শুধুই স্রষ্টার জন্য নিবেদিত। সমস্ত মানুষই সেই মহান সৃষ্টিকর্তারই সৃষ্টি। কাউকে বিচার করার ভার, বেহেস্ত-দোযখে পাঠানোর দায়িত্ব আমার উপরে অর্পিত হয়নি, সেই কাজের ভার সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছেই রেখেছেন। আমরা মনে হয় ভুলে যাই ধর্মের সেই অমোঘ বাণী।
আমি নিজেকে এই বলেই প্রবোধ দেই, সৃষ্টিকর্তা আমাকে যা দিয়েছেন দয়া করে, আমি তাতেই সুখী। আমি সবসময় অল্পে তুষ্ট থাকতেই পছন্দ করি এবং এতে আমার জীবনের অনেক জটিলতা নিমিষেই শেষ হয়ে গিয়েছে। নিজেকে আমি একজন সুখী মানুষ বলেই মনে করি। জীবনের প্রথম চাকুরী শুরু করেছিলাম স্কুল থেকে। অনেকের চোখেই জিনিষটা ভীষণ আপত্তিকর ঠেকছে। কতবার আমাকে শুনতে হয়েছে, ওমুক ওমুক ডিগ্রি নিয়ে শেষে কিনা স্কুল মাস্টারি?! আমার জনৈক মামাতো শশুর (আপন নয়) রীতিমত মানুষের কাছে ঘোষণা করে কটাক্ষ করেছেন আমার স্কুলের শিক্ষকতা করা নিয়ে। অথচ সামনাসামনি যখন কথা হত তখন রীতিমত ভালমানুষ ‘কার্তিক-ঠাকুর’ একেবারে। আমার কিছুই যায় আসে নি। কারো কোন জবাব দেবার দরকার মনে করিনি। আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছি এজন্য যে, আমার দুর্দিনে তো কেউ আমাকে কোন সাহায্য করতে আসেনি! কেউ তো তখন জানতে চায়নি আমি কেমন ছিলাম? এখন স্কুলের টিচার হওয়াতে মানুষের চোখ জ্বালা করা শুরু করলো? করুক যার যা ইচ্ছা করুক। আমার কিছু যায় আসে না। আমি আমার স্কুলের চাকরী নিয়ে ভাল ছিলাম। আস্তে আস্তে আমার প্রমোশন হয়েছে। স্কুল থেকে কলেজ লেভেলে অনেক কম সময়ে উন্নীত হয়েছি। এরপর চাকুরী পরিবর্তন করে এখন অন্য এক প্রতিষ্ঠানে। এতে কিন্তু আমার মাথায় কোন শিং গজিয়ে যায়নি। আমি আগে যা ছিলাম এখনও তাই আছি। আমার প্রথম জীবনের বেতন পেয়ে নিজেকে বলেছিলাম, স্রষ্টা আমাকে লাখ কোটি মানুষ থেকে ভাল রেখেছেন। এখনও আমি বলি, আমি অনেক অনেকের চাইতে অনেক বেশী ভাল আছি। অনেকে হয়ত আমার চেয়ে জীবনে অনেক বেশী কিছু করে ফেলেছে, কিন্তু খুঁজে দেখলে দেখা যাবে তাদের জীবনেও আছে কোন না কোন দুঃখের উপাখ্যান। পরিশেষে বলতে চাই, সবাই সুখী হোক যে যার অবস্থানে।