৪ জানুয়ারী ২০২০

কটাক্ষ করার সুযোগ পেলে অনেকেই ছাড়তে চায় না। চাইবেন কেন? এটা যে উনাদের একেবারে মজ্জাগত স্বভাব। এটা মনে হয় আমরা যে সমাজে বাস করছি, আমাদের আশেপাশে তাকালে অনেকের ভেতরেই দেখতে পারবো। যে কোন বিষয়ে অন্যকে খোঁটা দেয়ার সুযোগ পেলে ছাড়বে কেন? মনে করে খোঁটা দিতে পেরেছি, আমি অনেক বড়ো কিছু হয়ে গেছি। আর যাকে খোঁটাটা দিলাম, তাকে ভারী একখান বাঁশ দেয়া হয়ে গেল। কিন্তু এর দ্বারা যাকে বলা হল, তার মনে হয়ত সাময়িক একটা কষ্ট দেয়া হল যেটা সে একসময় হয়ত মনে রাখবে না। এটা নির্ভর করে কার মানসিকতা কতখানি শক্ত। কিন্তু যে খোঁটা দিল বা কটাক্ষ করলো, এই কাজের দ্বারা তার মনের কলুষতা আর নোংরামিরই বহিঃপ্রকাশ ঘটলো। আমাদের অনেকের সমস্যা এখানেই। মনের ভেতর এতটাই বেশী আবর্জনা পুষে রাখি যে সেগুলো আর চাপা দেয়া সম্ভব হয় না। কথায় কথায় বের হয়ে আসে। দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশে। ভাল একটা পরিবেশ নষ্ট করে ফেলাই এদের স্বভাব ধর্ম। অন্যরা কি করলো না করলো, কি পরলো, কোথায় গেল, কার সাথে গেল এগুলাই যেন তাদের গালগল্প করার প্রধান উপাদান হয়ে যায়। কোন মানুষের মধ্যে পরিবর্তনকে দেখতে তাদের ভাল লাগে না। তারা মনে করে, তাদের চোখে যা দেখতে ভাল লাগে সেটাই ঠিক। সবাইকে তাদের চোখে ভাল লাগার মত করেই থাকতে হবে। কেন রে ভাই? আপনি কে যে আপনার মত করে সবাইকে থাকতে হবে? সবার যার যার পছন্দ থাকতেই পারে। যদি দেশ, ধর্ম বা সমাজদ্রোহী কিছু না হয়, তাহলে করতে দিন না তাকে তার মত করে। আপনার কোন ক্ষতি হচ্ছে? যদি না হয় তাহলে শুধু শুধু নিযের ভেতরে কলুষতা উগরান কেন?

 

অনেক কিছুতেই অনেক উদাহরণ দেয়া যায়। সবকিছু উল্লেখ করার দরকার নাই। শুধু বলতে পারি আমাদের কারো কারো কিছু চোখের অভ্যস্ততার কথা। অন্যরা আমাকে যেমন দেখেছে, তার একটু ব্যতিক্রম হলেই বুঝি আমি অন্য কিছু হয়ে গেলাম! ২০০৭ এর আগে আমি টি-শার্ট, পোলো টি-শার্ট, শার্ট, প্যান্ট, থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট, ট্রাউজার এসবই পরতাম। সবাই সেগুলো দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেল। ২০০৭ এর শেষের দিক থেকে অভ্যাস একটি পালটে ফেললাম। নিয়মিত পাঞ্জাবী, পায়জামা, টুপি এগুলা পরতাম। তখন মানুষের চোখে পড়া শুরু হল। বলা শুরু হল, ঐযে ও তো এখন হুজুর হয়ে গেছে! আমি জানি না ‘হুজুর’ কি আসলে আলাদা কোন প্রাণী, শ্রেণী, নাকি অন্য কোন জাতের কিছু! আমি যতদূর জানি, ‘হুজুর’ শব্দটা একটা সন্মানজনক সম্ভাষণ যেটার ইংলিশ পারিভাষিক শব্দ হল Sirতাহলে পাঞ্জাবী পরার দ্বারা আমি ‘হুজুর’ হয়ে গেলাম, কথাটার মানে কি? কেউ যদি ইসলাম ধর্মের আচার আচরণ নিয়মিত পালন করা শুরু করে, অন্যদের চোখে সে হুজুর হয়ে যাবে? তাহলে অন্যদের চোখে আসলে ধর্মটা কি? ধর্ম কি তাহলে শুধু হুজুরদের পালনীয় কিছু? আর বাকীরা নিজেদের ইসলাম ধর্মের অনুসারী বলবে কিন্তু নিজেদের জীবন চালাবে বিন্দাস স্টাইলে? তাহলে ধর্মটা কোথায়? আমি তো সারাজীবন এটাই শিখে এসেছি, ধর্ম হল মনের বিশ্বাস এবং সেটা নিজের কর্মকান্ডে ফুটিয়ে তোলা। ধর্মের একটা অংশ বা অনুসঙ্গ হল উপাসনা করা। যার অংশ হিসেবে ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের প্রতিদিন পাঁচবার ‘নামাজ’ (ফার্সী শব্দ) নামক বাধ্যতামূলক উপাসনায় অংশ নিতে হয়। আমি এমন অনেক লোককে চোখের সামনে দেখছি, নিজে নামাজের ধার ধারে না, কিন্তু তার সামনে কেউ নামাজ পড়তে গেলে তাকে বড় বড় উপদেশ দিচ্ছে। কি করলে নামাজ হবে, বা হবে না সেসব কথা দেদারসে বলে যাচ্ছে। ধর্মটা কি ভাই তাহলে শুধু জিহ্বার স্বাদ আস্বাদনের জিনিস? নিজে পালন করছেন না কেন? কেন শুধু শুধু অন্যের পথে বাঁধা হচ্ছেন নিজের নোংরামি দিয়ে?

 

আমি আমার প্রবাস জীবনেও পাঞ্জাবী পায়জামা পরেছি। নিয়মিতই পরেছি। সেখানেও আমি গেঞ্জি প্যান্টও পরেছি পাশাপাশি। ধর্মীয় পরিমন্ডলে যখন গিয়েছি, মাথায় টুপি, পাগড়ি এগুলাও পরেছি। দেশে পরেছি, প্রবাসেও পরেছি। তখনও পরতাম এখনও পরি। কিন্তু টুপি পাগড়ি পাঞ্জাবী পাজামা এসব পরতাম দেখে, এখন শার্ট প্যান্ট গেঞ্জি এসব পরবোনা এমন মুচলেকা তো কারো কাছে দেইনি ভাই। আমার যখন যেটা পরতে ইচ্ছা করে আমি সেটাই পরছি। আমি তো ধর্মদ্রোহী কোন কাজ করিনি। ইসলাম ধর্মের অনুশাসন অনুসারে পুরুষ পূর্ণবয়স্ক মানুষের অবশ্যই হাঁটু ঢেকে পায়ের গোড়ালীর আগ পর্যন্ত লম্বা পোষাক পরা বাঞ্ছনীয়। সেটা যদি আমি জিন্স এর প্যান্ট পরেই করতে পারি, আমি যদি জিন্স এর প্যান্ট পরেই আমার নামাজ নিয়মিত পরতে পারি, তাহলে সেটা কেন মানুষের সমালোচনার বিষয় হবে? যদি সমাজবিদ্রোহী, ধর্মবিদ্রোহী কোন অশালীন পোষাক না পরি, তাহলে শুধু আপনাদের চোখের তুষ্টির জন্য কেন একজন মানুষের একরকম পোষাক পরতে হবে? আপনার নিজের যা ভাল লাগছে আপনি পরেন না। মানা করেছে কে? অন্যের দিকে না তাকিয়ে নিজের দিকে তাকালেই হয়।

 

গতকাল ওষুধ কেনার জন্য ফার্মেসীতে যাচ্ছিলাম। আমার শশুরবাড়ীর এলাকায়। আমার শশুরসাহেবের ভিটাবাড়ির সাথেই সংলগ্ন মসজিদ আছে অনেক প্রাচীন, যেটা উনার দাদা মুন্সী বকসে আলী সাহেব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই বৃটিশ আমলেই। ওবাড়িতে গেলে ওই মসজিদেই নামাজ পড়ি। ওখানকার মানুষ আমাকে এলাকার জামাই হিসেবেই চেনে। ওষুধ কিনে ফিরছি, সাথে সাথেই একজন পরিচিত মানুষের সাথে দেখা। আমাকে সালাম দিল। আমিও উত্তর দিয়ে মুসাফাহা (ইসলামিক রীতিতে দু’জনের চার হাত একসাথে মেলানোর রীতি) করলাম। উনি আমাকে চিনেন, আমি কেমন আছি, কি করছি এসব কুষলাদি জিজ্ঞাসা করলেন না। প্রথম কথাটাই যেটা বললেন, সেটা হল, ‘আপনি তো দেখি অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছেন’। আমাকে উনার ‘পরিবর্তন’(!) মনে হয়েছে এজন্য যে আমি পাঞ্জাবী পরা ছিলাম না। আমার পরনে ছিল একটা টি-শার্ট, জিন্স প্যান্ট যেটা গোড়ালীর উপর পর্যন্ত ভাঁজ করা। গলায় একটা রুপার চেন ছিল, তাতে ছিল একটা আমেরিকান মরগান সিলভার ডলারের পেন্ড্যান্ট! ব্যস, এতেই আমি পরিবর্তন হয়ে গেলাম। উনার কথায় মনে হচ্ছিল আমি মনে হয় জাত ধর্ম খুইয়ে বসেছি।  আমি উনার কথাটা শোনার সাথে সাথে উনার দিকে ভাল করে ফিরে তাকিয়ে বললাম, কি রকম পরিবর্তন? আমার কন্ঠের দৃঢ়তা শুনেই উনি বুঝে ফেলেছিলেন, আমি ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিয়েছি এবং উনার কথার উত্তর দেবার জন্য প্রস্তুত। সাথে সাথে উনি, ‘না কিছু না’ বলে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। উনি ভেবেছিলেন, পলায় রুপার চেন আর মরগ্যান ডলারের কয়েনের একটা লকেট পরেছি বলে আমি ভারী লজ্জা পেয়ে যাব উনার কথায়। মনে মনে এটাই আশা করেছিলেন। বেশীরভাগ মানুষই তাই করে। যখন কেউ তাদের পোষাক নিয়ে অযথা কটাক্ষ করে, তখন তারা লজ্জায় শামুকের মত গুটিয়ে যায়। এজন্য কটাক্ষকারীরা আরো মজা পেয়ে যায়। অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করতেও পিছপা হয় না। অথচ ইসলামের অমোঘ নির্দেশ ‘সীমা লঙ্ঘন করো না’। আমি যখন ক্লাস নেই, তখন শার্ট প্যান্ট, টি-শার্ট, জিন্স, সাধারণ প্যান্ট, পাঞ্জাবী পায়জামা, সবকিছুই তো পরছি। কই আমার প্রতিষ্ঠানের বা আমার ছাত্র ছাত্রীদের চোখে তো আমি পঁচে যাচ্ছি না। আসল সমস্যা আমাদের শিক্ষা আর মূল্যবোধের সমন্বয়ের অভাব।  

View shawon1982's Full Portfolio