‘হার্বারিয়াম’ Herbarium নামটার সাথে বেশী পরিচিত তারাই যারা উদ্ভিদবিদ্যা পড়েছেন বা এটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করেছেন। অনেকে হয়ত নিজের অজান্তেই হার্বারিয়াম তৈরী করেছেন কিন্তু নামটা এভাবে জানা হয় নাই। হার্বারিয়াম হল গাছের পাতা (মূলতঃ) বা অন্যান্য অংশের শুষ্ক রুপ যা পরবর্তীতে পর্যবেক্ষণের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে না হলেও, হার্বারিয়াম জিনিসটা আমার বেশ পছন্দের জিনিস সেই ছোটবেলা থেকেই। আমার থেকে বড় এক কাজিন আপার বইয়ের ভেতরে একবার দেখেছিলাম কিছু শুকনো লাল গোলাপের পাপড়ি। তখন থেকে আমিও গাছ থেকে গোলাপের পাপড়ি ছিঁড়ে ছিঁড়ে বইয়ের পাতার ভাঁজে ভাঁজে রেখে দিতাম। সেই ক্লাস থ্রি ফোরের কথা হবে। বড়দের অনেকে গোলাপের পাপড়িটা অবশ্য একটা বিশেষ স্মৃতিকে উদ্দেশ্য করে রেখে দিত, সেই উদ্দেশ্য বোঝার মত বয়স তো আমার তখন ছিল না। আমি এমনি এমনিই রাখতাম। অন্যরা রাখে, তাই আমাকেও সেটা করতে হবে। বড়দের কাছ থেকে দেখা এমন চটকদার কোন জিনিস নিজের মধ্যে নিয়ে আসাকে তখনকার দিনে আমার কাছে বিশেষ ক্রেডিটের মত মনে হত। মনে হত আমিও তাদের মতই বড় হয়ে যাচ্ছি।
আমার স্কুলের বন্ধু জিতু একদিন তার বই খুলে আমাকে ওর বানানো একটা হার্বারিয়াম দেখালো। সম্ভবত গন্ধরাজ ফুলের হবে। দেখে আমার খুব আকর্ষণীয় লাগলো। গন্ধরাজ ফুলের হার্বারিয়ামটা নিয়ে নাকের কাছে এমনভাবে শুকতে লাগলো যেন ওখান থেকে এখনও তাজা গন্ধরাজের গন্ধ বেরিয়ে আসছে। কি পরিতৃপ্ত একটা ব্যাপার স্যাপার! আমি বললাম আমাকে একটু দে তো শুকে দেখি! ওমা শুকে দেখি কিসের ফুলের গন্ধ? কেমন একটা কাঠ কাঠ গন্ধ পাচ্ছি। কিন্তু জিতু যেহেতু গন্ধ পেয়েছে, এই অবস্থায় আমি যদি বলি গন্ধ পাই নি, তাহলে তো মান ইজ্জতের ফালুদা হয়ে যেতে পারে! তাই বললাম, বাহ কি সুন্দর গন্ধ! আমিও একটা বানাবো। স্কুলের গেটের কাছে গন্ধরাজ গাছ ছিল। ওখান থেকে একটা প্রস্ফুটির গন্ধরাজ নিয়ে স্কুল ভ্যানে করে বাসায় চলে আসলাম। আমার কাছে তখন সুকুমার রায়ের সমগ্র ছিল। ওটার ভেতরে রেখে দিয়ে বইটা চাপা দিয়ে দিলাম। ভালমত যেন হয়, সমগ্রের উপরে ভারী ভারী আরো কয়েকটা বই রেখে দিলাম। এতেও মন মানলো না, চাপ কি যথেষ্ট হল? রান্নাঘর থেকে শিল-নোড়ার নোড়াটা এনে তার উপরে রেখে দিলাম। এবার মনে মনে কিছুটা নিশ্চিত। জিতুর মত একটা শুকনা গন্ধরাজ আমার চাইই চাই! না হলে প্রেস্টিজ থাকবে না! প্রায় প্রতিদিনই উলটে পালটে দেখতে লাগলাম বেচারা চাপ খেয়ে মরা গন্ধরাজ ফুলটাকে। সারা পাপড়িগুলোতে বাদামী রঙ লেগে গেল। শুকিয়ে গেল ফুলটা। হয়ে গেল আমার কিশোর বয়সের বানানো প্রথম হার্বারিয়াম। বহুকাল সেটা আমার সাথে ছিল। আগে বইয়ের যত্ন তেমন বুঝতাম না। কোথায় যে হারিয়ে গেছে সুকুমার রায়ের সেই বইটা আমার আর মনে নেই। কিন্তু গন্ধরাজের সেই হারাবিয়ামটার কথা মনে আছে।
১৯৯৯ এ এপ্রিল মাসে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে গেছিলাম নানুবাড়িতে বেড়াতে। একদিন সকালে উঠে দেখি নানুর হাতে গোল করে পাকানো দুই গোছা শাপলা। উদ্দেশ্য হল শাপলার কান্ডটাকে (আঞ্চলিক ভাষায় ‘নাল’) কেটে ভাজি বা তরকারী করা হবে। আমার খুব পছন্দের খাবার শাপলার তরকারী। নানু আমাকে দেখে বললো, ‘তোমার জন্য কিনছি। ঢাকায় তোমরা এসব খাও কি না খাও’! সুন্দর সুন্দর নীল রঙয়ের শাপলা ছিল! মনে হয় সদ্য তুলে আনা কোন বিল থেকে। ফেরী করে বিক্রি করছিল, নানু তার কাছ থেকে কিনে নিয়েছেন। নানুকে বললাম, আমাকে একটা ফুল দাও তো। আমি বেছে বেছে সুন্দর একটা নিয়ে পাপড়িগুলো সুন্দর করে ছিঁড়লাম। ছোটবেলার ব্যাপারটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। হার্বারিয়াম বানাবো। সাথে কোন একটা গল্পের বই ছিল। তার পাতার ভাজে ভাজে অনেকগুলো শাপলার পাপড়ি রেখে দিলাম। পরে সেটা ঢাকায় এনে একটা ডায়রীর ভাজে রেখেছিলাম। বহুকাল ডায়রীর পাতার ভাঁজে ছিল পাপড়িগুলো। আবার খুঁজে দেখবো। ডায়রীটা পেলে হয়তো দেখবো, আমার নানুর কেনা সেই শাপলার শুকনো পাপড়িগুলো এখনো আছে। হার্বারিয়াম তো শুধু একটা বাহানা মাত্র। আসলে আমি মাঝে মাঝে বড্ড স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। শুধু পুরনো কথা মনে পড়ে। ফেলে আসা দিনগুলো আর ফেলে আসা মানুষগুলোর কথা মনে পড়ে।