স্বীকৃতি পাওয়াটা যে কোন মানুষের জন্য অতীব আনন্দের ব্যাপার। যদি আমার কোন কাজের মূল্যায়ন হয় বা এরজন্য পুরস্কৃত করা হয় তাহলে সেই আনন্দ নিঃসন্দেহে অপরিসীম হয়ে যায়। অবশ্য যারা অতি বড় মাপের মানুষ, যাদের নামটাই একটা Brand হয়ে যায়, তারা স্বীকৃতির উর্ধ্বে চলে যেতে পারেন অনায়াসে। যেমন পেরেছিলেন ফরাসী সাহিত্যিক জ্যঁ পল সার্ত্রে, ভিয়েতনামের নেতা লে ডুক থো তাঁদের স্বীয় নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখান করে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রত্যাখান করেছিলেন, ব্রিটিশ রাজের দেয়া Knight উপাধি। লতা মঙ্গেশকর ৪র্থ বার প্লে-ব্যাক গায়িকার ফিল্ম ফেয়ার পুরষ্কার নেয়ার পর বলেছিলেন, আমাকে আর যেন কখনও এই পুরষ্কারের মনোনয়নে রাখা না হয়। আর নেননি উনি এই পুরষ্কার। যাদের কথা উল্লেখ করলাম, তাঁদের সামনে আমি কোন ছার-পোকা! মহান এইসব ব্যক্তিত্বের সামনে আমি আমার কোন অস্তিত্ত্বই দেখি না। বরং আমি হলাম সেই পথিক যে ক্লান্ত হয়ে সেইসব বটবৃক্ষতুল্য মানুষগুলোর নিকটে ছায়া খুঁজি প্রতিনিয়ত।
কিছুদিন আগে আমার বাবা আমাদের ডায়নিং টেবিলে বসে আলাপচারিতার ফাঁকে এক প্রসঙ্গে আমার উপর বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে যান। আমি বললাম, তুমি পড় আমার লেখা? উনি ক্ষিপ্ত হয়েই বললেন, তোমার লেখা পড়বো না, ভবিষ্যতেও পড়তে চাই না। আমি উত্তর দিলাম, সেটা তোমার ইচ্ছা তুমি পড়বা কি পড়বা না। এটাও আমার এক ধরণের প্রাপ্ত পুরস্কার বলতে হবে, কারণ আমি আমার লেখা বৃশ্চিক অভিধানের শুরুর দিকের একটা অধ্যায়ে বলেছিলাম, আমার আব্বু আম্মু আমার লেখা পড়েন না। সেজন্য উনি ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। হতেই পারেন। আমার লেখা পড়ে একজন ক্ষিপ্ত হয়েছে, এটাও আমার প্রাপ্তিই বলতে হবে। কারণ আমার লেখার কিয়দংশ পড়েই উনি বাস্তবতে মেনে নিতে পারেন নাই।
মাত্র কিছুদিন আগেই আমার মেয়ে জুওয়াইরিয়া ওর নানুবাড়ী থেকে একটা ছড়ার বই নিয়ে আসলো। বইটার নাম “ছাব্বিশ ছড়ার কারিগর”। ছাব্বিশজন ছড়াকারের ছড়ার সমন্বয়ে বইটি সাজানো হয়েছে। প্রকাশন নূরনবী বেলাল ভাই। বইটির কথা আমি প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম। মেয়ের হাতে দেখে মনে পড়লো ওই ছাব্বিশজনের একজন আমিও। আমার লেখা তিনটি ছড়া ঐ বইতে সংকলিত হয়েছে। মেয়ে বাসায় এসেই আমাকে দেখে অনেক উত্তেজিত হয়ে বললো, বাবা, বাবা! এইটা তোমার বই! আমি বললাম, কে বলেছে তোমাকে বাবা? ও বললো, আম্মু বলেছে, নানু বলেছে। মেয়ের বয়স মাত্র সাড়ে পাঁচ হল। অক্ষরজ্ঞান হয়েছে কিন্তু শব্দ পড়তে পারে না এখনও। ওর মায়ের কাছ থেকে দেখে নিয়েছে কোন পৃষ্ঠায় আমার লেখা ছড়াগুলা আছে। ভাল করে ছবিটা মনে গেঁথে নিয়েছে। এরপর ওকে আমি বহুবার দেখেছি, বইটা খুলে আমার লেখা ছড়ার পৃষ্ঠা খুলে তাকিয়ে আছে অপলক ভাবে। বাসার সবাইকে দেখানো হয়ে গেছে, এটা বাবার বই! আমাকে বলেছে, বাবা তোমার কবিতা পড়ে শোনাও। আমি ওকে পড়ে শুনিয়েছি।
মেয়েটা আমার লেখা ছড়াগুলার উপর হাত বুলায়। ইশ্বরের হাত তো দেখিনি এই নশ্বর চোখে, কিন্তু আমার মনে হয়েছে, দয়াময় সৃষ্টিকর্তা আমার মেয়ের হাত দিয়ে আমাকে আশীর্বাদ করে দিলেন। এটাই আমার জীবনের পাওয়া সবচেয়ে বড়ো স্বীকৃতি বলে মনে করি। দুইদিন আগে, আব্বুদের সতীর্থ বন্ধুদের তরফ থেকে আমাকে একটা ক্রেস্ট দেয়া হয়েছে, আমার ডক্টরেট ডিগ্রির স্বীকৃতি স্বরূপ। মেয়ের অসুস্থতার কারনে আমি নিজে উপস্থিত হয়ে সেটি নিতে পারিনি। মেয়ে আমার কাছ থেকে দেখে শিখে নিয়েছে কিভাবে ক্রেস্টটাকে বক্সে সেট করতে হয়। এখন কেউ এলে তাকে দেখায়, বলে এটা আমার বাবা পেয়েছে। আমার এই জীবনে কি পেয়েছি আর কি পাইনি তার হিসেব আমি মেলাতে বসবো না, কিন্তু এটা আমি অবশ্যই সর্বান্তকরণে স্বীকার করবোই, আমার মেয়ে আমার লেখার যে স্বীকৃতি দিল কিছু না বুঝেই, সেটা এই পার্থিব পৃথিবীতে পাওয়া আমার সর্বশ্রেষ্ঠ অপার্থিব স্বীকৃতি।