২৬ ডিসেম্বর ২০১৯

আচ্ছা! এঞ্জিনিয়াররা দেখতে কেমন হয় আপনারা জানেন? তাদের কি কোন বিশেষ চেহারা থাকে? কারণ এই বিষয়ে আমিও একসময় পাস করেছিলাম তো, আমি আমার চেহারার মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য দেখিনি। আগে যেমন ছিলাম তেমনই আছি। দুইটা চোখ, দুইটা হাত, পা ঠিক সব আগের মতই। আহা! এঞ্জিনিয়ার হবার সাথে সাথে যদি মাথায় দুইটা শিং গজাতো, তাহলে কতই না ভাল হত তাই না? সবাইকে Show-off করে বেড়াতে পারতাম, দেখ দেখ আমি না এঞ্জিনিয়ার! আমার মাথায় দুইটা শিং আছে। শো-অফ করা বা মানুষ দেখানোর ব্যাপারটা আমাদের অনেকের মধ্যেই আছে। অগোচরে কাজও করে। আবার অনেকে শো-অফ করতে পারলে তো নিজেকে আবার ধন্য মনে করে। আমার কাছে ব্যাপারগুলা চরম মজাদার কিছুই লাগে। অনেকটা চটকদার চাটনীর মত সুস্বাদু। তবে অবশ্যই নিজে করতে না, অন্যদের শো-অফ দেখতে। সে দেখাতে চাইছে, আমিও দেখছি। মজা নিচ্ছি।

 

নানুবাড়িতে বেড়াতে গেছিলাম ২০০৬ সালের দিকে। তখন আমার জনৈকা নানী (আমার নানার চাচাতো বোন) নানুবাড়ীতে বেড়াতে এলেন। মানুষটা ছোটখাট, গলায় পরেছেন মোটামুটি প্রকান্ড সাইজের একটা স্বর্ণের চেন। তাঁর ভেতর আবার বল বল ডিজাইন করা ছিল। তা মহিলাদের যা স্বভাব আরকি, পাশে দাঁড়ানো অন্য একজন মহিলা উনার চেনটা হাতে ধরে বললো, ‘ভাল সুন্দর তো! কোত্থেকে কিনিসেন’? (খুলনার আঞ্চলিক ভাষায় লিখলাম)। শুনে আমার সেই নানীর চোখ পরিতৃপ্তিতে বুজে বুজে আসছিল। কোথা থেকে কিনেছেন সেই বর্ণনা করতে গিয়ে উনার চোখ খুলে রাখাই কিছুটা দুষ্কর হয়ে যাচ্ছিল। আহা কি শান্তি! কেউ তাঁর চেন দেখেছে, জানতে চেয়েছে। আহা জীবন!

 

সিঙ্গাপুরে যখন প্রথম গেলাম পড়তে, আমার প্রথম দিনের হোস্টেলের ঘটনা। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। ঘরে যাব। কালকে বাসে করে প্রথম ভার্সিটি যেতে হবে। লিফটের ভেতর দেখলাম কয়েকটা চায়নিজ মেয়ে উঠে যাচ্ছে। আমিও উঠতে যাব, আমার ওদের জানিওতে ইচ্ছে হল ওরাও আমার মত একই ভার্সিটি NUS এ পরে কিনা। আমি আমার স্বভাবগত স্টাইলে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমরা কি ‘নাস’ এ পড়? মেয়েগুলা আমার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো? আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম একই প্রশ্ন। ওরা তখন আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘নাস’ কি জিনিস? আমি দ্বিধায় পরে গেলাম। Elaborate করে বললাম ‘নাস’ কি জিনিস। ওরা তখন জানালো ওরাও একই ভার্সিটিতে পরে এবং ওরা কখনই ‘নাস’ বলে না। ওরা বলে ‘এন ইউ এস’। অর্থাৎ ওরা আমাদের মত কোন এব্রিভিয়েশনকে শব্দের মত করে উচ্চারণ করে না। পরের দিন ভার্সিটিতে একজন সিনিয়র প্রফেসরের সাথে দেখা হবার পরে হাই হ্যালো দিলাম। উনি জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি Undergrad কোথা থেকে করেছ। এইবার, আমি ফুল ইলাবোরেশনে বললাম। উনিও শুনে বললেন, ‘ও ইউ আর ফ্রম বি ইউ ই টি’। আমি বললাম, ইয়েস স্যার! সেদিনের পর থেকে মনে মনে শিক্ষা নিলাম, আমরি বাঁচি, আর কোনদিন কোন এব্রিভিয়েশনকে আর শব্দের মত করে উচ্চারণ করবো না। তাতে সে বুঝুক নার না বুঝুক। সেই অভ্যাস আমি চিরতরে ত্যাগ করেছি। কারণ, ‘বুয়েট’ শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়ে আমি অনেকের ভেতর যে ‘অহঙ্কার’ দেখেছি, সেটাকে যদি ‘বি ইউ ই টি’ বলা হয় তাহলে আমার দেখা দৃষ্টিতে অহং-বোধের মাত্রা কিছুটা হলেও কমে যায়। আমি যা আমি সেটাই। আমার কাজের মাধ্যমে ফুটে উঠুক আমার যোগ্যতা। শো-অফ করে নিজের নাম ফুটানো আমি পছন্দ কোন কালেই করি না।

 

আমাকে বাংলাদেশেও যখন কেউ জিজ্ঞাসা করতো আমি কোথায় পড়ি (ছাত্র অবস্থায়), তখনও আমি কৌশল করেই উত্তর দিতাম। অ্যাকাডেমিক লাইনের কেউ না হলে আমি ‘বুয়েট’ কথাটা উচ্চারণ করতামই না। আমাকে জিজ্ঞাসা করতো, কোথায় পড়? আমি বলতাম, জ্বী ভার্সিটিতে পড়ি। কোন ভার্সিটি জিজ্ঞাসা করা হলে বলতাম, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। তখন অনেকেই কিছুটা বিস্মিত হয়ে জানতে চাইতো, বুয়েট? আমি আরো সাধারণ ভাবে জবাব দিতাম, ঐ আর কি, যা বলেন আপনারা! একজন বাইরের মানুষের মোটামুটি তিন চারটা প্রশ্ন করে জেনে নিয়ে নিশ্চিত হতে হত আমি আসলে কোথায় পড়ি। আমার ছাত্র সেদিন একজন ক্লাসে জিজ্ঞাসা করেছিল, স্যার আপনি আন্ডারগ্র্যাড কোথায় পড়েছেন? আমি বললাম, (ঠাট্টা করেই), তুমি আমার প্রোফাইল না জেনে আমার ক্লাসে এসেছো কেন? তোমাকে এখনই আমার সাবজেক্ট ড্রপ করে দিতে হবে। পুরা ক্লাসে হাসির হল্লা উঠলো। ছেলেটা আবার বললো, বলেন না স্যার কোথায়? আমি যথারীতি বাংলায় বললাম। ছেলেটার চোখে আমি কিছুক্ষণ একটা শূন্য দৃষ্টি দেখলাম। ওর বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগছিল। সাথে সাথে ওর পাশে বসা একটা মেয়ে ওকে কনুই দিয়ে গুতা দিয়ে চাপাস্বরে বলল, তুই বুঝিস নাই? স্যার বুয়েটে পড়েছেন! ছেলেটা এটা শুনে স্বাভাবিক জগতে ফিরে এল। আমিও আগে বাড়তে লাগলাম ওদের সাথে পরিচয় পর্বে।

 

বাংলা ব্যাকরণে আমাদের ভাব সম্প্রসারণ করতে দেয়া হত, ‘নাম মানুষকে মহৎ করে না, মানুষই নামকে জাঁকাইয়া তোলে’। আমি সারাজীবন কথাটা মেনে এসেছি এবং এখনও মানতে চেষ্টা করি। আমার বিস্তৃতি ঘটুক আমার কাজের মাধ্যমে। নিজের নাম নিজে ফুটিয়ে নিজেকে হাস্যস্পদ করে নিজেকে ভাঁড় হিসেবে উপস্থাপন করার মধ্যে কোন কৃতিত্ব আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। সবচেয়ে বড় কথা হল, আমি যা আসলে আমি তা-ই। বিখ্যাত লেখন O’Henry এর গল্প The Gift of the Magi এর একটা উক্তি দিয়ে আমার আজলের লেখা শেষ করছি, ‘I am me, without my hair, ain’t I?’  

View shawon1982's Full Portfolio