‘বড়-মা’ (Great Grandmother) কথাটা আমরা আমাদের ছোটবেলা থেকে নানু-দাদুর অথবা নানা-দাদার মা কে বোঝাতে উল্লেখ করি। অর্থাৎ প্র-মাতামহী বা প্র-পিতামহী কে আমরা বড়-মা বলি। সেই হিসাবে আমি আমার চারজন বড়-মা এর মধ্যে মাত্র একজনের দেখা পেয়েছি যখন আমার বয়স মাত্র সাড়ে তিন কিংবা সর্বোচ্চ চার বছর। তিনি হলেন আমার নানুর মা অথবা অন্যভাবে বললে আমার মায়ের নানী (Maternal Great Grandmother)। এছাড়া আমি আমি আমার আব্বু বা আম্মুর কারোরই দাদা-দাদী বা নানা-নানীকে দেখিনি। আমার জন্মের আগেই উনারা চিরবিদায় নিয়েছেন। ছোটবেলা থেকেই বড়-মা অথবা বড়-আব্বা এই সম্পর্ক বিষয়ে আমার একটা কৌতুহল কাজ করতো। অনেক বয়ষ্ক একজন মানুষকে মা বা আব্বা বলতে হচ্ছে! ব্যাপারটা আমার খুব মজা লাগতো। আমি আমার মায়ের নানী বা বড়-মা কে যখন দেখেছি, তখন আমি নিতান্তই অনেক ছোট। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, উনার সাথে সাক্ষাতকারের সেদিনের সেই দৃশ্য আমার মানসপটে অস্পষ্ট অবয়বে হলেও আঁকা আছে। নানু আর আম্মুর সাথে বড়-মা কে দেখতে গিয়েছিলাম উনার বাড়ীতে অর্থাৎ আমার নানীর বাবার বাড়ীতে। খুলনার বয়রাতে আমার নানুর বাবার বাড়ী। সাদা শাড়ি পড়া, ধবধবে সাদা, দুধে আলতায় গায়ের রঙ এর একজন অতিশয় বৃদ্ধা মহিলা আধশোয়া হয়ে বসেছিলেন। আমাকে বলে দেয়া হয়েছিল ইনি আমার বড়-মা হন। বড়-মার চেহারা আমার মানসপটে নেই হুবহু কিন্তু সাদা শাড়ী পড়া অনিন্দ্যসুন্দর একজন বৃদ্ধা আমার বড়-মা ছিলেন। সেটা মনে আছে।
আমার বড়-মা’র নাম ছিল শামসুন্নাহার বেগম। বড়-মার বিস্তারিত কোন ইতিহাস আমার জানা নেই। আমার এই ক্ষুদ্র লেখার উদ্দেশ্য হল আমার সামান্য স্মৃতিটুকুর ভেতর আমার অক্ষম লেখনীতে আমার বড়-মা কে নিয়ে আসা। আম্মুর কাছ থেকে এতটুকু জানতে পেরেছি যে, আমার বড়-মা তাঁর বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলেন। তাঁর আর কোন ভাই বোন কিছুই ছিল না। দুই দিকেরই উত্তরাধিকার সূত্রেই বিপুল ঐশ্বর্যের উত্তরাধিকারিনী ছিলেন। বড়-মার বিয়ে হয়েছিল বয়রার শেখ সাদাত হোসাইনের সাথে। যিনি আমার বড়-আব্বা ছিলেন। আমার বড়-আব্বাদের বাড়ী বয়রাতে ‘খালাসী বাড়ি’ হিসেবে সুপরিচিত। বয়রাতে খালাসী-বাড়ি বললে একনামে সবাই চেনে। আমার বড়-আব্বা এবং বড়-মা সেই বৃটিশ আমলেই কতখানি উদার এবং উন্নত মানসিকতার অধিকারী ছিলেন সেটা আমরা পরে বুঝতে পেরেছিলাম। তৎকালীন যুগে মুসলমান মেয়েদের শিক্ষাদীক্ষার অবস্থা কি ছিল সেটা আমরা সবাই জানি। অনেক রক্ষণশীলতার মধ্যে মেয়েরা প্রতিপালিত হত। মেয়েদের লেখাপড়ার কথা তখন প্রায় ভাবাই হত না। আমার নানী, আমার বড়-মার গর্ভজাত সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়। আমার নানু সেই আমলেই ক্লাস টেন পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিলেন। নানু পড়তেন খুলনা সরকারী করোনেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। যে স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন বাংলাদেশে এক রত্ন বেগম সুফিয়া কামাল। আমার নানু ট্রেনে করে স্কুলে যাতায়াত করতেন। নানু নিয়মিত বই, খবরের কাগজ পড়তেন। এ থেকেই আন্দাজ করে নিয়েছিলাম বড়-মা কতখানি দূরদর্শী ছিলেন মেয়ের লেখাপড়ার ব্যাপারে।
সম্প্রতি আমাদের ছেড়ে চির-বিদায় নিয়েছেন বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র শাম্মী আখতার। বহু জনপ্রিয় গান গেয়েছেন। অনেক বাংলা সিনেমাতে প্লে-ব্যাকও করেছেন। শাম্মী আখতারের বাড়িও খুলনার বয়রাতে। দূর দূর দিয়ে শুনেছিলাম উনি নাকি আমাদের আত্মীয় হন। তখন আমার নানু বেঁচে ছিলেন। নানুকে জিজ্ঞাসা করা মাত্রই বললেন, ‘শাম্মী? ও তো আমার মায়ের খালাতো বোন’। শাম্মী আখতার ম্যাডামের সাথে আমার এক অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল। আমার বন্ধু তনয়ের সুবাদে উনার কাছে গিয়ে উনার সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল সেই ২০০০ সালে। আমি উনাকে বলেছিলাম, আপনি কিন্তু আমার আত্মীয় হন। আত্মীয়তার সূত্র বলার সাথে সাথে উনি ভীষণ ভাবে বিস্মিত হয়ে যান। চিনতে পেরেছিলেন আত্মীয়তার সূত্র। বলেছিলেন, আমার বাড়ীও তো বয়রাতে! যদিও আমার বড়-মা আর শাম্মী আখতারের বয়সের বিস্তর ব্যাবধান ছিল। তবুও তো, আপন খালাতো বোন তো ছিল।
আমার নানু দেখতে একদম আমার বড়-মার মতই ছিলেন। দেখতে এবং গায়ের রং দুই দিকেই প্রায় হুবহু বলা চলে। আমি সেটার প্রমাণ পেয়েছিলাম ১৯৯৭ সালে। বড় খালার বাসায় পুরানো অ্যালবাম ঘাটতে ঘাটতে বড়-মার একটা ছবি পেয়েছিলাম। বসা অবস্থায় তোলা ছবি। সাদা শাড়ি পরা সাদা-কালো একটা ছবি। আমার খালাতো বোন বলেছিলেন এইটা হল আমাদের বড়-মা। আমার চোখে সেই ছোটবেলার দৃশ্য ভেসে উঠলো। খাটে শোয়া বড়-মা কে দেখতে গিয়েছিলাম। নানু তখন বড় খালার বাসাতে ছিলেন। রান্নাঘরে কিছু একটা রান্নার তদারকি করছিলেন। বড়-মার ছবিটা উনাকে দিয়ে বললাম নানু বলতো এটা কে? উনি চশমা ঠিক করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখে বললেন, আমার মা। এর অনেক বছর পরে বড়-খালার বাসায় ছবিটা আবার অনেক খুঁজেছিলাম। কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। আর খুঁজে পাইনি ছবিটা। কথাটা মনে হলেই মনের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে।