প্রিয় অর্ক,
আমার আজকের সব কথা মূলত তোমাকে উদ্দেশ্য করে। যদি তোমার নজরে এটা পড়ে তবেই আর কি! তোমাদের যখন দেখি, তখন আমার নিজের ভার্সিটির আর স্কুল কলেজের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। যখন পরীক্ষার দিন গুলো এগিয়ে আসতো আমার মনে হত আমি মরে যাই। আমার বেঁচে থাকা তখন রীতিমত অর্থহীন মনে হত। আমি ভাই কোনকালেই তেমন আহামরি টাইপ কোন ছাত্র ছিলাম না। নিতান্তই ছা-পোষা টাইপ বলতে পারো। স্কুল লাইফে পড়াশোনা করার জন্য মাঝে মাঝে কঠিন লেভেলের ঝাড়িও যে শুনতে হয়নি তা কিন্তু না। তবে মনে হয় কিঞ্চিত সুবোধ টাইপ বালক ছিলাম।
আমার আব্বুর স্বপ্ন ছিল আমি হয়ত বোর্ড স্ট্যান্ড করবো। তোমাদের সময় যদিও এটা ছিল না, কিন্তু তুমি নিশ্চই এই জিনিসটা তোমার বড়দের কাছে শুনে থাকবে। ব্যাখ্যায় আর গেলাম না। আব্বুর স্বপ্ন দেখতে তো নিষেধ ছিল না, কিন্তু আমি সেই যোগ্য ছিলাম না। দোষ বল বা অযোগ্যতা যাই বল না কে ভাই, সবটাই আমার। আমার বাবার চেষ্টার কোনই কমতি ছিল না। তারপরেও আমি পারিনি তাঁর স্বপ্ন পূরণ করতে। ম্যাট্রিকে বা মাধ্যমিকে ২০ তম স্ট্যান্ড হল ৯২১ মার্ক নিয়ে সেখানে আমার কপালে জুটলো ৮ টা লেটার সাথে ৯১৮ নাম্বার! মাত্র তিন নাম্বার! আব্বু সহ কত মানুষের দীর্ঘশ্বাস মেশানো কথা আমাকে শুনতে হয়েছে। অথচ আমার পিতৃ-মাতৃকূলে আমার নাম্বারটাই ছিল মাধ্যমিকে রেকর্ড মার্ক। ইংলিশে ৩ নাম্বারের জন্য লেটার মিস করেছিলাম, আর সেই ৩ নাম্বারের জন্যই স্ট্যান্ড ও করতে পারলাম না। আমাদের রেজাল্ট দিয়েছিল ১৯৯৯ সালের ১৭ই জুন। আমি আমার বড় খালার বাসায় বসে রেজাল্ট শুনেছিলাম। আমার নানু তখন বেঁচে ছিলেন এবং বড় খালার বাসাতেই ছিলেন তখন। বেড়াতে এসেছিলেন। রেজাল্ট শুনে খুশি হয়েছিলেন। কিছুটা আফসোস করে আমার খালাতো বোনকে বলেছিলেন আমার কথা, ও ইংরেজিতে একটু কাঁচা! আহারে! আজ যদি নানু বেঁচে থাকতেন, আমার PhD এর থিসিসটা আমি উনাকে দিয়ে আসতাম। PhD চলাকালীন শেষবর্ষে নানু মারা গেলেন। দেখে যেতে পারলেন না, তাঁর সবচেয়ে আদরের নাতিটা, যাকে চারটা বছর নিজের হাতে পেলেছেন, ইংরেজীতে কাঁচা হাতে কেমন একটা থিসিস লিখে ফেলেছে!
ইন্টামিডিয়েট বা উচ্চমাধ্যমিকে আব্বু আবার আশায় বুক বাঁধলেন। এবার হয়তো স্ট্যান্ড করেই ফেলবো। এবার রেজাল্ট হল আরো বেশী রকম খারাপ। এবারো কাকতালীয়ভাবে সেই ৯২১ এই লাস্ট স্ট্যান্ড নাম্বার ছিল। আমি পেলাম ৮৬৬, সাথে ৪ টা লেটার। আমার মনে হয়েছিল মাটির সাথে মিশে যাই! লজ্জায় কারো দিকে তাকাতেও পারতাম না। আব্বু আম্মুর দিকে তাকাতাম না পারতপক্ষে। আমার অগোচরে উনাদের হাহাকার মেশানো কত দুঃখের কথা শুনতে হত! আমি তখন আক্ষরিক অর্থে নিজেকে ঘরবন্দী করে ফেলেছিলাম। কারো সাথে মিশতাম না। বাইরেও যেতাম না। কোচিং করতাম না ভর্তির জন্য। মাত্র এক সপ্তাহ কোচিং করে ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমার কাছে অনেক কঠিন মনে হচ্ছিল। নিজের মধ্যে এওটুকু সাহস ছিল, স্ট্যান্ড করতে পারিনি তো কি হইছে, আমি আমার পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই ছাড়বো! একা একাই নিজের মত করে পড়া লেখা করে যেতে লাগলাম। এখনকার ছেলেমেয়েরা তো কত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফর্ম কেনে! এখন আমার চিন্তা করলেও গায়ে কাঁটা দেয়, আমি মাত্র দুইটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফর্ম কিনেছিলাম। আমার চিন্তা ছিল এসপার ওসপার টাইপ। আমাকে আমার টার্গেট পূরণ করে দেখাতেই হবে। সৃষ্টিকর্তা সহায় ছিলেন। আমি আমার টার্গেট পেয়ে গিয়েছিলাম।
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভর্তি পরীক্ষা যখন দিলাম ২০০১ সালে, ঐদিন ১৭ নাম্বার রোজা চলছিল। রোজা রেখেই পরীক্ষা দিয়েছিলাম। আব্বু গেটের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন চিন্তিত মুখে। কাছে গেলাম, উনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। অনেকটা যেন নিজেকেই সান্ত্বনা দিলেন আর কি। আমিও শুকনা একটা হাসি দিলাম। উনি মনে হয় তেমন ভরসা পেলেন না। জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন হল? আমি ঠিক এই উত্তরটাই দিয়েছিলাম, চান্স পাবো ইনশাআল্লাহ। তবে কোন সাবজেক্টে পড়তে পারবো সেটা ঠিক বলতে পারছি না। এইটুক শুনে আব্বু আর কিছু বললেন না। ঈদের ঠিক একদিন আগে রেজাল্ট দিয়েছিল। চান্স পেয়েছিলাম। এই হল আমার ছোট্ট একটু এগিয়ে যাবার উপাখ্যান। আরো কত কিছু আছে বলার। পরে বলবো না হয়।
ইতি,
তোমার এক ভাই
পুনশ্চঃ তোমাকে বিদ্রোহী বলি মনে আছে তো? আবার না হয় আরেকটা বিদ্রোহ করলেই।