‘পলিথিন ব্যাগ’ কে কথ্য আরবী ভাষায় কি বলে জানেন? আচ্ছা না জানলেও অসুবিধা নেই। আমার এই লেখা একটু কষ্ট করে পড়লেই জেনে যাবেন। কথায় আছে না সবুরে মেওয়া ফলে? আমার এই লেখার জন্য বলতে হচ্ছে, সবুরে ‘পলিথিনের আরবী’ ফলে! ১৯৮৮ এর জানুয়ারী থেকে ১৯৮৯ এর নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ২৩ মাস সৌদি আরবের আর-আর শহরে ছিলাম। বয়স ছিল ৬ বছরের মত! বাইরের পরিবেশে মিশতাম না বা বড়রা ছাড়া একদমই ঘর থেকে বের হতাম না। আমার বড় খালার বাসা ছিল আমাদের একই গলিতে। গলির এমাথা ওমাথা। আমি বেশীরভাগ সময় বড় খালার বাসাতেই থাকতাম। খালাত ভাইটা ছিল একদম আমার বয়সী আর খালাতো বোনটা ছিল আমাদের থেকে ক’বছরের বড়। ওদের সাথেই আমার যাবতীয় সখ্যতা ছিল। প্রধান খাবার ছিল চকলেট। এগুলোর মধ্যে, Snickers, Mars, Twix, Galaxy এগুলাই প্রধান ছিল। আর একটা জুস খুব খেতাম আমরা তিনজনই। সেটার নাম ছিল Sun Top। চিপ্স একটা খেতাম যেটার নাম ছিল Fish-Fash এই জাতীয় কিছু। ওটার টেস্ট এখন বাজারে পাওয়া চিজ-বল এর মত কিছুটা। খালাতো ভাইবোন ওদের কাছে যা কিছুই দেখি না কেন, সেটাই আমারও লাগবে। আমাকে ঐ একই জিনিস কিনে দিতেই হবে। খেলনার তো কোন কমতি ছিল না।
যদিও সারাক্ষণ বাসা কেন্দ্রিক থাকতাম, তবুও পরিবেশের কারণে টুকটাক ভাষা তো একটু রপ্ত হয়েই যায়। একদিন বাসার পানি শেষ হয়ে গেল। আম্মু বললো, যাও বারান্দায় গিয়ে নিচে বাড়িওয়ালাদের বল, ‘মইয়া মাফি’! লোকাল আরবীতে এর অর্থ হল, ‘পানি নেই’। আমি বারান্দায় গিয়ে নিচে বাড়িওয়ালী মহিলাকে দেখে তারস্বরে চিৎকার করে বললাম, মইয়া মাফি! মহিলা আমার চিৎকার শুনে চমকায়ে উপরের দিকে তাকায়ে আমাকে দেখে হেসে ফেললো। আমি এক ছুটে আবার বাসার ভেতরে। কোন এক অজানা কারণে আমার মধ্যে স্থানীয় আরবদের ব্যাপারে একটা ভীতি কাজ করতো। আরব পুরুষরা মাথায় যে ‘বীড়া’ বা বিশেষ ধরণের পাগড়ী পরে, আমি সেটাকে বলতাম , ‘ঝুটি’। আরবদের অনেক বয়স্ক লোকের দাঁত স্বর্ণ দিয়ে বাঁধাই করা থাকে। এরফলে উনারা যখন হাসেন তখন স্বর্ণের দাঁতটা ঝিকমিক করে উঠতো। এতেও আমার ভয় লাগতো!
সৌদি থেকে যখন দেশে চলে আসলাম, তখন নিজেকে খাপ খাওয়াতে কয়টা মাস ভীষণ কষ্ট হয়েছে। কারণ চেনা পরিচিত আমার প্রধান খাদ্যগুলো তো আর পাচ্ছি না! এসব তো বাংলাদেশে তখন পাওয়াই যেত না। কোন কিছুই তো আর মিল পাচ্ছি না। দোকানে কিছু নেয়ার পরে বলতাম, ‘কিস দেন’। দোকানদার টাস্কি খাওয়া চোখে তাকিয়ে থাকতো। আমিও অবাক হতাম এমন করে কি দেখে, আমি তো একটা ‘কিস’ চাইলাম! কিস ছাড়া জিনিস নিব কিসে? সৌদি আরব বা মিডল ইস্ট এর দেশগুলোতে যেসব ভদ্র মহিলারা দীর্ঘদিন থেকেছেন, তাদের মনে হয় এই জাতীয় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে বহুবার নিজের অজান্তে পড়তে হয়েছে। বোরকা পরা কোন ভদ্রমহিলা যদি নিউ মার্কেটে শাড়ী কিনে দোকানদারকে বলে ‘কিস দেন’ তখন পরিস্থিতি কি হতে পারে পাঠক বুঝে নিন! নিশ্চই আর কারো বুঝতে বাকী নেই, কথ্য আরবীতে পলিথিন ব্যাগকে ‘কিস’ বলে! আমার এই ভাষা পরিস্থিতি সামলে উঠতে একটু সময় লেগেছিল। দেশে এসে যখন প্রথম নানুবাড়িতে বেড়াতে গেলাম, হাতে একগাদা মার্বেল নিয়ে নোয়া-মামীর (চতুর্থ মামী) কাছে চলে গেলাম। বললাম মামী ‘কিস’ দাও তো। মামী তার রান্না বাদ দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললেন, আয় আব্বা দেই! এই বলে আমার গালে আদর করে চুমু দিয়ে দিলেন! আমার মনে আছে, সেবার নানুবাড়ীতে ঐ আমি শেষবারের মত পলিথিন ব্যাগকে কিস বলেছিলাম। এরপরে মন থেকে ঐ শব্দটা একেবারে Shift-Delete করে দিয়েছিলাম।