৬ ডিসেম্বর ২০১৯

‘অটোগ্রাফ’ সংগ্রহ করার প্রতি এ যুগের ছেলেমেয়েদের তেমন কোন বাড়াবাড়ি ধরণের আকর্ষণ আছে বলে মনে হয় না। ইন্টারনেট এর কল্যানে পছন্দের তারকার অটোগ্রাফ বা স্বাক্ষর সম্বলিত ছবি পাওয়া যায় অহরহ। আমি যখন স্কুলে পড়তাম তখন ‘টেলিভিশন’ খ্যাত তারকার অটোগ্রাফ সংগ্রহ করার শখ হয়েছিল ১৯৯৪ সালে। এবং সেই ঘটনার শুরু একুশে ফেব্রুয়ারী বই মেলা থেকে। স্কুলে বন্ধুদের কাউকে কাউকে দেখেছি অটোগ্রাফ নিয়ে আলোচনা করতে। বন্ধু ইমরান একদিন ক্লাসে আমাকে বলল, এই মাসের ‘কিশোর তারকালোক’ কিনেছিস? আমি বললাম, না কেন? ও বললো, ‘এই মাসেরটা কিনে রাখ। এই মাসের থিম হচ্ছে ‘অটোগ্রাফ’। অনেক টিভি তারকার অটোগ্রাফ আছে। কালেকশনে রাখার মত’। ইমরান আমাকে আরো কয়েক দফা বোঝানোর চেষ্টা চালালো। কিন্তু আমি শেষমেশ ঐ কিশোর তারকালোক আর কিনি নাই। আমার কাছে মনে হয়েছিল, ছাপার কাগজে অটোগ্রাফ নেয়ার চাইতে, যদি সরাসরি উনাদের কাছ থেকে নিতে পারি, সেটাই হবে বেশী আকর্ষণীয় ব্যাপার। যখন ক্লাস ফোরে পড়ি, তখন বন্ধু জিতু জানালো কৌতুকাভিনেতা ‘মিঠু’ ওদের বাসায় আসে। আমি বলেছিলাম, আমাকে উনার একটা অটোগ্রাফ এনে দিস। জিতু এনে দিয়েছিল একটা কাগজে। সেটা আমার একটা ডায়রীতে রেখে দিয়েছিলাম। এটাই ছিল আমার জীবনে পাওয়া প্রথম কোন তারকার অটোগ্রাফ।  

 

আব্বুর সাথে ১৯৯৪ সালে ফেব্রুয়ারীতে গিয়েছিলাম বাংলা একাডেমীতে বই মেলায়। ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন। আর্থার কোনান ডয়েলের একটা বইয়ের অনুবাদ কিনে আব্বুর সাথে ঘুরছি। হঠাৎ দেখি একখানে বেশ ছোটখাট একটা জটলা। আব্বু আমার হাত ধরে টান দিয়ে বললো, এদিকে আসো। দেখলাম পাঞ্জাবী পরা একজন সৌম্য দর্শন তারকা এবং তাঁর স্ত্রী দুজনে দাঁড়িয়ে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। আমি উনাদের নাম মনে করতে পারছিলাম না। তবে চিনতে পারছিলাম। টিভিতে দেখেছি। এ দু’জন সন্মানিত তারকা ছিলেন আমাদের দেশের দুই কিংবদন্তী শিল্পী ‘খান আতাউর রহমান’ এবং ‘নিলুফার ইয়াসমিন’। আমার কাছে তো কোন ডায়রী ছিল না। কি করি? সবাই দেখি হৈ চৈ করে উনাদের দিকে ডায়রী এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে। উনারা অটোগ্রাফ দিচ্ছিলেন। একটা লোক তাঁর ঝোলায় করে কাছেই ছোট ছোট ডায়রী বিক্রি করছিল। বাংলা একাডেমীর পকেট সাইজ ডায়রী। আব্বু জলদি করে একটা কিনে নিল আমার জন্য। দিয়ে বললো, যাও উনার কাছ থেকে অটোগ্রাফ নিয়ে নাও। কয়েকজনের পরে আমার সুযোগ আসলো। খান আতা সাহেব হাসিমুখে আমাকে অটোগ্রাফ দিয়ে দিলেন। এটাই হচ্ছে আমার জীবনে পাওয়া দ্বিতীয় অটোগ্রাফ। এরপরে নিলুফার ইয়াসমিন ম্যাডামকে খুঁজলাম। উনি ততক্ষণে সরে পড়েছেন। উনার অটোগ্রাফ আর পাওয়া হল না। মনে সেই আফসোস আজও রয়ে গেছে। এখন হাজার মাথা কুটে মরলেও এই দুই কিংবদন্তীর দেখা মিলবে না। দু’জনই চিরতরে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন। এরপরে আরেক দোকানে দেখা পেলাম আরেক নাট্যব্যক্তিত্ব ‘নাদের খান’ সাহেবের। উনার কাছ থেকেও নিয়ে নিলাম অটোগ্রাফ।

 

পরে ক’বছর সেই ডায়রীটা নিয়েই আবার বইমেলায় গেলাম। এবং সেটা ১৯৯৮ সালের ঠিক ২১শে ফেব্রুয়ারীতেই। ডঃ জাফর ইকবাল এর একটা বই কিনে নিয়ে বিভিন্ন স্টলে ঘুরছি। এমন সময় এক স্টলে পেয়ে গেলাম অনেকটা প্রত্যাশিত ভাবেই ডঃ হুমায়ূন আহমেদ কে! চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি আমার প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ কে! আর নড়লাম না সেই স্টল থেকে। দোকানের সামনে রীতিমত ভাল রকমের ভীড় লেগে গেল। দোকানের এক লোক আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, বই টই কিছু আছে? আমার হাতে থাকা ডঃ জাফর ইকবালের বইটাই এগিয়ে দিলাম! উনারই তো ভাইয়ের বই! বইটা যখন প্রিয় লেখকের হাতে গেল, আমার দিকে তাকালেন মানুষটা। বললেন, কি নাম? বললাম, ‘শাওন’। উনি লিখে দিলেন, ‘শাওন, ২১শের শুভেচ্ছা। হুমায়ূন আহমেদ’। দোকান থেকে এসেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, আমি হুমায়ূন আহমেদের অটোগ্রাফ পেয়েছি! আমার কাছে আছে এখনও সেই অটোগ্রাফ। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগ পর্যন্ত আমার এই অটোগ্রাফ প্রীতি ছিল। পরে সেই ইৎসাহে ভাটা পড়ে যায়। ইন্টারনেট যখন একটু একটু ব্যবহার করছি তখন খালাতো ভাই নেট থেকে ম্যাডোনা আর লতা মঙ্গেশকরের অটোগ্রাফ সহ ছবি প্রিন্ট করে দিয়েছিল। সেটা আমি ল্যামিনেট করে নিজের সংগ্রহে রেখে দিয়েছিলাম। তখন কি বুঝতাম, ইন্টারনেটের এই অটোগ্রাফ আমি যখন তখন নিতে পারি?  

View shawon1982's Full Portfolio