১ ডিসেম্বর ২০১৯

পরীক্ষাভীতি আমার খুব ছোটবেলা থেকেই কাজ করে। আজও করে। এখনও কোন পরীক্ষার কথা শুনলে ভয়ে আমার আত্মা শুকিয়ে ‘শুষ্কং কাষ্ঠং’ জাতীয় কিছু হয়ে যায়। ছাত্র হিসেবে আমি কোন কালেই আহামরি টাইপ কিছু না। সাধারণ সাদামাটা বললেও অত্যুক্তি হয় না। কিন্তু পরীক্ষার ভয়? কত চেষ্টা করলাম, গেলই না। কোন পরীক্ষায় যদি খুব ভাল মত প্রস্তুতিও নিয়েছি, তাতেও আমি ভয়ে মোটামুটি আধমরা হয়ে যাই। আব্বু আম্মু কত সান্ত্বনা দিয়েছে। বারবার বলেছে, যা হবার হবে, তবুও আমার ভয় কাটেনি। পরীক্ষার আগের রাতগুলো ঘুমাতে পারতাম না। খেতে অরুচি লাগতো। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় জীব বলে মনে হত। স্কুলে যখন পড়তাম তখন ডিসেম্বর মাস আসা মানেই আমার আতঙ্কের মাস উপস্থিত। দিন গুনতাম কবে শেষ হবে আমার উপর এই নির্যাতন! কবে বড় হব? কবে আমার পরীক্ষা দেবার দিন শেষ হয়ে যাবে? পাংশু মুখে এঘর থেকে ওঘর ঘুরে বেড়াতাম, সবাইকে দেখতাম। আমার দুশ্চিন্তায় কারো তো কিছু হচ্ছে না, তাহলে আমিই কেন এমন অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছি? ভীষণ দুশ্চিন্তার মধ্যেও মাঝে মাঝে টেলিভিসন দেখতে মন চাইতো। স্কুলজীবনে বাংলাদেশ টেলিভিসনটাই মূল সম্বল ছিল। ওটাই দেখতাম। যেই পল্লীগীতি বা যাত্রার অনুষ্ঠান অন্য সময়ে মরে গেলেও দেখতাম না, পরীক্ষার আগে সেই যাত্রা দেখতেও কত ভাল লাগত! অভিনেতাদের চিৎকার করে বলা ডায়লগ শুনলেও মনে হত, এই জীবনটাও কত ভাল। এরা আমার চেয়েও কত সুখী! এদের তো আর কাল পরীক্ষা দিতে হবে না।

 

স্কুলে যখন থেকে একা যাওয়া শুরু করেছি, তখনও পরীক্ষার দিনগুলোতে আব্বু আমাকে তার হুন্ডায় করে স্কুলে নিয়ে যাতেন। আমি সবসময় মটর বাইককে ‘হুন্ডা’ বলি। উনি মনে করতেন, আমি আমার অস্বাভাবিক দুশ্চিন্তার কারণে হয়ত রাস্তা ঠিকমত পার হতে পারবো না। হুন্ডা থেকে নেমে যখন আব্বুকে বলতাম, আসি! দোয়া কইরো। এই কথাটুকুও আমার গলা দিয়ে ঠিকমত বের হত না। আব্বু বলতো, যাও, পরীক্ষা তোমার ভাল হবে। বলে মাঝে মাঝে কপালে একটা চুমু দিতেন। আমি পরীক্ষার হলের দিকে এগিয়ে যেতাম দোয়া দুরুদ সব পড়তে পড়তে। এমনিতে আমার হাত ঘামে না, কিন্তু পরীক্ষার ভয়ে এমন হত আমার। তবে একটা জিনিস আমি বরাবর খেয়াল করেছি, আমার সব ভয় প্রশ্ন হাতে পাওয়ার আগে। প্রশ্ন হাতে পাওয়ার পরে, ভয় যেন কোথায় চলে যেত। লেখার ভেতরে এমন মশগুল হয়ে যেতাম যে তখন আর ভয়ের কথা মনে থাকতো না। কিন্তু একটা জিনিস আমাকে বরাবরই ভাবিয়ে তুলতো, যখন আমি দেখতাম, আমার নিজের প্রশ্নটাই পড়া হয় নাই শেষ পর্যন্ত, আর আমার ঠিক পাশের জন তার ভেতরেই এক পৃষ্টা লিখে ফেলে পাতা উল্টাচ্ছে! তখন আবার নিজেকে কিঞ্চিত অসহায় মনে হত। হায়! ও তো কত কিছু লিখে ফেলেছে, আমি তো এখনও লেখা শুরুই করিনি। পরীক্ষা আর এই ভয়ভীতি নিয়ে আমার অনেক অনেক স্মৃতি জমে আছে। সবগুলো, একসাথে লিখে পাঠককে বিরক্ত করবো না। মাঝে মাঝে লিখবো।

 

এখন তো পরীক্ষা আর দেয়া লাগে না। এখন পরীক্ষা দিই না বরং নিই। কিন্তু আমার অবচেতন মনে পরীক্ষার যে ভয় রয়ে গেছে তা থেকে আমি মুক্তি পাইনি। পরীক্ষার হলে পরিদর্শকের কাজ যখন করি, তখনও আমার সেই পুরনো কথা মনে হতে থাকে। চোখের সামনের ছাত্রগুলোর যায়গায় আমি নিজেকে কল্পনা করতে থাকি। আমার আবার একটি একটু ভয় লাগতে থাকে। প্রায় রাত্রেই আমি দুঃস্বপ্ন দেখি। আমি স্বপ্ন খুব কম দেখি। যাও যৎকিঞ্চিত দেখি, তার আদ্যোপান্তই দুঃস্বপ্ন থাকে প্রায়। আমার দেখা দুঃস্বপ্নের বেশীরভাগই থাকে পরীক্ষা বিষয়ক। আমি হলে বসে আছি, টেনশন করছি। আমার হাতে প্রশ্ন দেয়া হল। আমি তার কিছুই লিখতে পারছি না। এমন একটা ভয়াবহ মূহুর্তে আমার ঘুম ভাঙ্গে। অনেক্ষণ লাগে আমার স্বাভাবিক হতে। নিজেকেই নিজেকে প্রবোধ দিতে হয়, আমি এখন আর পরিক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া কোন ছাত্র না।  

View shawon1982's Full Portfolio