চিঠি লেখা আমার খুব প্রিয় একটা শখ ছিল। আমার অনেক শখ আছে যেগুলো সেই শৈশব থেকে টিকে আছে। কিন্তু চিঠি লেখাটা মনে হয় চিরতরে বিদায় নিয়েছে। এখন আর কে চিঠি লিখবে? কার এত সময় আছে? সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন আছে, ইমেইল আছে, মেসেঞ্জার আছে। চিঠির যে আর কোন অস্তিত্ত্বই নেই। এখনকার ছেলে-মেয়েরা চিঠি তো মনে হয় আর চেনেই না। এ যুগের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে প্রেম আছে, ফেসবুক আছে, চ্যাটিং আছে; কিন্তু নেই শুধু চিঠি। অথচ একসময় চিঠিতেই লেখা হত মনের যত না বলা কথাগুলো। চিঠিতে লেখার সেই অমোঘ আবেদন কি এখনকার ইমেইলে আছে? যে যাই বলুক না কেন, আমি বলবো নেই। একেবারেই নেই। ইমেইলে সেই আবেগের ছিটেফোঁটাও নেই যা চিঠিতে ছিল। একটা প্রিয় মানুষের চিঠি হাতে নিয়ে বারবার পড়তে কত ভাল লাগতো, কিন্তু এখন ইমেইল একবার পড়লেই ফুরিয়ে যায়। বারবার পড়ার কিছুই থাকে না যে। এক এক জনের হাতের লেখা এক এক রকম। সেই মানুষটার চিঠি হাতে নিলে মনে হত যেন মানুষটার একটা অদৃশ্য স্পর্শ পাওয়া যাচ্ছে। কি যে একটা ভাললাগে কাজ করতো। মনের মধ্যে একটা শিহরণ কাজ করতে থাকতো। এখন বাটনের মাত্র একটা চাপেই চিঠি চলে যাচ্ছে, ভিডিও চ্যাটিং এ চেহারা দেখেই কথা বলা যাচ্ছে, কিন্তু তবুও কোথায় যেন কি একটা হারিয়ে গেছে যা চিঠির ভেতর ছিল।
চিঠি নিয়ে আমার যে কত কত স্মৃতি আছে! পোষ্টাল খামগুলো পাওয়া যেত মাত্র দুই টাকা করে। হলুদ রঙ এর খামগুলো। যে কোন মুদির দোকানেও পাওয়া যেত। আমি কিনে আনতাম পোস্ট অফিস থেকে। পঞ্চাশ টাকা দিয়ে ২৫ টা খামের বান্ডিল কিনে আনতাম। এক টাকা করে পাওয়া যেত পোস্টকার্ড। মাঝে মাঝে ওগুলোতেও লিখতাম। কিন্তু পোস্টকার্ডের লেখাগুলো থাকতো একদম খোলা। সেই ১৯৯৪ সালে যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, তখন আমাদের ইংলিশ বইতে ‘পেন-ফ্রেন্ড’ বা পত্র-মিতালির মাধ্যমে বন্ধুত্বের ব্যাপারটার উল্লেখ ছিল। তখন থেকে আমার কি অদম্য উৎসাহ পেন-ফ্রেন্ডশিপ করার ব্যাপারে। কিন্তু কোথায় পাব? সবাইকে বলে বেড়াতাম। কাকে চিঠি লিখবো? চিঠি লেখার যে মানুষ আর পাই না।
আমার পরিচিত এক আঙ্কেল তার সৌদিতে থাকা এক ফিলিপিনো সহকর্মীর এক কাজিনের ঠিকানা দিয়েছিল কোন এক সময়। আঙ্কেল সেই মেয়ের নাম ঠিকানা আমাকে দিয়েছিল। মেয়ের বয়স কত, কি করে, কিছুই জানতাম না। লিখ দিলাম একটা ইংরেজিতে চিঠি। চিঠিটা কিভাবে লিখবো বা কি কি লেখা উচিত সেটা আব্বু আমাকে বলে দিয়েছিল। সুন্দর প্যাঁচানো অক্ষরে লিখলাম আধা পৃষ্ঠার এক চিঠি। তাতে লিখে দিলাম, আমি তোমার সাথে পেন ফ্রেন্ডশিপ করতে চাই। পোস্ট করে দিলাম চিঠিটা। এরপর শুরু হল অখন্ড অপেক্ষার পালা। মাস পার হয়ে যায় যায়। ভাবলাম আমার চিঠিটা মনে হয় ওর হাতে আর যায়নি। তখনকার দিনে রেজিস্ট্রি করে না দিলে চিঠি প্রাপকের কাছে পৌঁছাবে না, এমন ঘটনা খুব সাধারণ একটা ব্যাপার ছিল। এটাকে বলা হত চিঠি মার যাওয়া। আমি ভাবলাম, আমার চিঠি মার গেছে। ফিলিপিনো মেয়েটার সাথে বন্ধুত্বের আশা যখন বাদ দিচ্ছিলাম, তখন নীল-রঙের খামে করে সুদূর ফিলিপাইন থেকে উড়ে এল আমার সেই কাঙ্খিত চিঠি। আমার সে কি আনন্দ। কি সুন্দর নীল রঙের খাম! কি সুন্দর একটা স্ট্যাম্প লাগানো! আব্বুর অফিসের ঠিকানা দেয়া ছিল। সেই ঠিকানায় এসেছিল চিঠিটা। খাম যেন নষ্ট না হয়, এমন সাবধানে চিঠিটা খুলেছিলাম। সাধা কাগজে, নীল রঙের ফাউন্টেন পেনে লেখা ছিল সেই চিঠিটা। পড়ে জানতে পারলাম, আমি মেয়েটার নামের বানান আর ওর এলাকার নামের বানান ভুল লিখেছিলাম। ও সেটা কারেকশন করে দিয়েছে। মেয়েটার নাম ছিল Nida P. Aquino। আমার প্রথম পাওয়া কোন বিদেশীর চিঠি! মেয়েটা জানালো সে একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। আমার চেয়ে অনেক বড়। লেখাপড়া নিয়ে অনেক ব্যস্ত থাকতে হয়। সে আমাকে কালে প্রকারে বুঝিয়ে দিল যে, তার আসলে চিঠি লেখালিখি করা হয়ে উঠবে না। আমি মেয়েটাকে আর কোন চিঠি দেই নি কিন্তু তার চিঠি আমার কাছে বহুদিন ছিল। বাসায় কেউ এলেই আমি তাকে খুব আগ্রহ করে মেয়েটার চিঠি দেখাতাম।
আমি আমার নানুর কাছে দুই দফা চিঠি লিখেছিলাম। আমার নানু পরম যত্ন করে আমার সেই চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন নিজের হাতে লিখে। খামের উপরে ঠিকানাটাও নানু লিখেছিলেন। নানুর সেই লেখা চিঠি দুইটা কিভাবে যেন আমি আলাদা করে রেখেছিলাম। আমার যাবতীয় চিঠি কোথায় চলে গিয়েছে আমি বলতে পারবো না। কারণ সিঙ্গাপুরে চলে যাওয়ার পরে আমার জিনিসগুলোর আর কোন যত্ন হয়নি। বাসা পরিবর্তন হয়েছে। আর আমার জিনিসপত্র আমি যেমন মায়া নিয়ে যত্ন করতাম, সেটাও আমার ঘরের লোকের কাছে আদিখ্যেতা। আমার বিয়ের পরেও আমি চিঠিগুলো পেয়েছিলাম। কিন্তু এখন সেগুলো কোথায় আমি জানি না। সরিয়ে রেখেছিলাম। আমার ভাগ্য অনেক ভালও বলতে হবে। আমার নানুর লেখা চিঠিদুইটাই এখনও অক্ষত ভাবে আমার কাছে রয়েছে। সেই সাথে রয়েছে আমার বড় মামার লেখা দুইটা চিঠি। আমার বড় মামা ২০০৬ সালে আর নানু ২০১২ তে আমাদের ছেড়ে চির বিদায় নিয়ে চলে গেছেন। উনাদের হাতে লেখা চিঠি রয়ে গেছে। চিঠির প্রতি অক্ষরে অক্ষরে এখনও মনে হয় উনাদের আশীর্বাদ ঝরে ঝরে পড়ে আমার মাথার উপরে।
ফিরোজ নামে পঞ্চগড়ের একটা ছেলের সাথে আমার বেশ ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। অনেকগুলা চিঠিই ওর সাথে চালাচালি করেছিলাম। চিঠির ভেতরে মাঝে মাঝে ছবি ওয়াশ করে পাঠিয়ে দিতাম। তখন আস্তে আস্তে কুরিয়ার সার্ভিস জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল। চিঠির মধ্যে আরো অন্য কিছু দিতে চাইলে কুরিয়ারে পাঠাতাম। আর মাত্র এক দিনের মধ্যে পেয়ে যেত, সেটা ছিল একটা বড় আকর্ষণের ব্যাপার। একবার ফিরোজ আমাকে সবুজ রঙের কালিতে চিঠি লিখেছিল। ভীষণ সুন্দর লেগেছিল। আমি আমার উত্তরে সেই কথা বলেছিলাম। পরের চিঠিতেই ফিরোজ আমাকে সেই কলমটা কুরিয়ার করে পাঠিয়ে চিয়েছিল। Montex এর জেল পেন। গাড় সবুজ রঙ এর। সে যে কি এক ভাললাগা! কি যে এক বন্ধুত্ব! সে বন্ধু আমার কোথায় হারিয়ে গেছে যেন! নেই ওর ঠিকানা আর আমার কাছে। কোথায় আছে, কেমন আছে জানি না। হারিয়ে গেছে চিঠিগুলো। কিন্তু আমার মনে পড়ে ফিরোজের কথা। জানি না বন্ধুটা আমার কোথায় আছে কেমন আছে? এখনও ওর আমার কথা মনে আছে কিনা!
এমিল নামে আরেক জনের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল। এমিলের সাথে ফেসবুকের সুবাদে এখনও পরিচয় আছে। যদিও আমি এখনও এমিল কে সরাসরি দেখিনি। ফোনে কথা বলেছি। এমিল এখন ইতালিতে থাকে। চ্যাটিং করেছি। দেশে এসেছিল বছর দুই আগে। নানা ব্যস্ততায় আমার সাথে দেখা করতে পারেনি। সেই কারণে আমার মনে আক্ষেপ ছিল। দেখা হল না আজও। হয়তো কোনদিন দেখা হয়ে যাবে বন্ধু এমিলের সাথে। এমিল আমার চেয়ে বছর কয়েকের ছোট হবে। এমিলের হাতের লেখা ছিল সুন্দর। চিঠি লিখেছিল সুন্দর করে গুছিয়ে।
স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে উঠে গেছি। চিঠি লেখার নেশা তখনও যায় নি। এক কাজিনের বাসা আদাবরে ছিল। ফোনে কথা হত, ওদের বাসাতেও নিয়মিত যেতাম। কিন্তু ওর সাথেও চিঠিপত্র লিখতাম জাস্ট মজা করে। চিঠি ছেড়ে দিয়ে এসে ফোনে বলতাম, চিঠি দিয়েছি। ও আমাকে লিখতো। ভার্সিটি থেকে পোস্ট করতো। আড্ডা দিচ্ছি, ঘুরছি, বেড়াতে যাচ্ছি, আবার চিঠিও লিখছি। ও তেলাপোকা খুব ভয় পেত। আমার মনে আছে। আমি একটা মরা তেলাপোকার ডানা ছিড়ে ওর কাছে লেখা একটা চিঠিতে সেটা দিয়ে দিয়েছিলাম! উত্তরে ও আমাকে লিখেছিল, ‘আমার প্রাণপ্রিয় জিনিসটা পাঠানোর জন্য তোমাকে ধন্যবাদ জানাইতেসি। জিনিসটা দেখিয়া আমার প্রাণপাখি উড়িয়া যাইবার জোগাড় হইয়াছিল’। নিছক ঠাট্টা করেই আমরা মাঝে মাঝে সাধু ভাষায় চিঠি লিখতাম। এখনও আমরা একই শহরে বাস করি। বছরের পর বছর পার হয়ে যায়, আর কোন কথাও আমাদের মধ্যে হয় না। দূরত্ব যেন কিভাবে বেড়ে যায়।
কলেজে পড়াকালীন সময়ে বাসায় ‘দৈনিক জনকন্ঠ’ রাখা হত তখন। সপ্তাহে একদিন দিত ‘শব্দ-জব্দ’ টাইপের বাংলা ক্রসওয়ার্ড পাজেল। বেশ সহজ। দেখতাম যারা সঠিক উত্তর দিতে পেরেছে, সবার নাম উল্লেখ করতো, আর তাদের মধ্যে থেকে দুইজনকে পুরষ্কার দিত বই। যারা পুরষ্কার পেত তাদের ঠিকানাও উল্লেখ করে দিত। পুরষ্কার পাব এমন আশা করি নি, তবে আমিও নিয়মিত প্রতি সপ্তাহেই শব্দজব্দ এর উত্তর খামে পাঠাতে লাগলাম। সঠিক উত্তর দাতাদের মধ্যে যখন আমার নামটা দেখতাম, তখন কি যে এক অপার্থিব আনন্দ হত সেটা কাউকে বোঝানো যাবে না। বারবার পেপারটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ছাপানো অক্ষরে নিজের নামটা দেখতাম। এভাবে দুই তিন সপ্তাহ গেল। আমি নিয়মিত ঐ ধাঁধাঁর উত্তর পাঠাতে লাগলাম। একদিন সকাল বেলা নিজের চোখকেই বিশ্বাস করাতে পারলাম না। আমি পুরষ্কার পেয়েছি! কি আনন্দ! সে কি উত্তেজনা! আমার সেই আনন্দে মনে হয়েছিল আমি বিশ্বের সবচেয়ে সুখী মানুষ। কারণ আমি পুরষ্কার পেয়েছি।
সেবার আমার সাথে পুরষ্কার পেয়েছিল খুলনার একটা ছেলে। এবং মজার ব্যাপার হল তার নামও শাওন। আমাদের দুইজনের একই নাম! যেহেতু ঠিকানা দেয়া ছিল, আমাকে আর পায় কে! আমি ঐ শাওনকে বন্ধুত্বের প্রস্তাব দিয়ে চিঠি পাঠিয়ে দিলাম। কিছুদিনের মধ্যেই শাওনের উত্তর পেলাম। কি অপূর্ব ওর হাতের লেখা! এখনও চোখে ভাসে। এক কথায় আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ও আমার বন্ধুত্ব গ্রহন করেছিল এবং বলেছিল আমাকে চিঠি লিখবে। জেনেছিলাম ওরও পত্র-মিতালী করার শখ আছে। আমি শাওনকে অনেক বড় বড় চিঠি লিখতাম! কত কিছু যে লিখতাম! ও আমাকে লিখতো। শাওনকে আমি কুরিয়ারে চিঠি দিতাম মাঝে মাঝে। ছবি পাঠাতাম। দারুণ জমে উঠেছিল আমাদের বন্ধুত্ব। সেই বন্ধুত্ব এখনও আছে আমাদের। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পরে নানুবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। তখন শাওনের সাথে আমার দেখা হয়েছিল। ওর বাসাতে গিয়েছিলাম। দুপুরে খেয়েছিলাম ওদের বাসাতে। এরপর যখন ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম, তখন শাওনও এসেছিল আমাদের বাসায়। এখন ফেসবুকে যোগাযগ আছে। শাওন এখন অস্ট্রেলিয়াতে থাকে।
এখন যুগ, প্রযুক্তি, বন্ধু সবকিছুই হাতের নাগালে আছে। নেই শুধু চিঠি লেখার সেই দিনগুলো। চিঠি লিখে পোস্ট করে, সেই চিঠির উত্তরের জন্য পরম আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকার মধ্যে সে যে কি এক উন্মাদনা, কি এক ভাল লাগা, সেটা আমি কি করে বোঝাই? সেই যুগ, সেই সময় যারা পেয়েছে তারাই শুধু বুঝতে পারবে আমার এই অদম্য আবেগের কথা। আমি চিঠি পত্রে কখনও প্রেম করিনি, তাই চিঠিপত্রে প্রেমের বিষয়টার অভিজ্ঞতা আমার নেই কিন্তু সেই যুগে যারা চিঠি লিখে প্রেম করতো তাদের কাউকে কাউকে তো দেখেছি। সেই আকুলতা এখনকার চ্যাটিং এর যুগের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে যে কতখানি আছে সেটা ওরাই ভাল জানে।