এঞ্জিনিয়ার শব্দটার মানে এখনও অনেকের কাছেই ‘টেকনিশিয়ান’ বা আরো প্রাঞ্জল ভাষায় মিস্ত্রী বললে মনে হয় অত্যুক্তি হবে না। আমাদের আশে পাশে এমন মানুষের অভাব নেই যারা সুযোগ পেলেই কোন ডিগ্রিধারী মানুষকে খোঁচা দিয়ে বা অপমান করার সুযোগ পেলে ছেড়ে দেয় না। শিক্ষিত মানুষকে অপমান করার মধ্যে তারা এক ধরণের বিজাতীয় বা পৈশাচিক আনন্দ লাভ করেন। এটা হতে পারে তাদের না পাওয়ার বেদনা থেকে করে। আবার হতে পারে, এটাই হয়ত তাদের মজ্জাগত স্বভাব। শিক্ষিত মানুষ বেশীরভাগ সময়ই যে নিজের ডিগ্রির উপর আক্রমন হতে দেখলেও চুপ থাকে। কারণ এই সব অর্বাচীন দের সাথে তর্ক করতে যাওয়াই সবচেয়ে বড় মূর্খতা। এর চেয়ে মনে হয় চুপ থাকাই শ্রেয়।
২০০২ সালে আমার সাথে ঘটা একটা স্মৃতি আপনাদের সাথে শেয়ার করি। এখানে আমি যে কথা বলবো সেটা আমি কাউকে নিশ্চই অসন্মান করার জন্য বলব না। শুধু আপনারা একটু হলেও ধারণা করতে পারবেন আরকি! প্রকৌশব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পরে গ্রামের বাড়ী বেড়াতে গিয়েছি আব্বুর সাথে। তখনো ক্লাস শুরু হয়নি। বাজারের রাস্তায় আব্বুর এক প্রাক্তন শিক্ষকের সাথে দেখা। স্যারের নাম আমার মনে নেই। আমি সালাম করে হাত মিলালাম উনার সাথে। আব্বু বললো, ‘স্যার, আমার ছেলে, বুয়েটে চান্স পেয়েছে। ওর জন্য দোয়া কইরেন’। আমার দাদাতুল্য স্যার আমার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে বললেন, ‘ভাল ভাল। কিন্তু তোমার ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলো না?’ আব্বু হেসে দিয়ে সাথে সাথে উনাকে এঞ্জিনিয়ারিং এর কিছু কথা বুঝাতে গেলেন। আমি উনার মুখের দিকে তাকিয়ে তেমন কোন ভাবান্তর দেখলাম না। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন পড়লাম না, সে কারণে উনার ভেতর একটা প্রশ্ন কাজ করছিলো। হয়ত মনে মনে ভেবেই নিয়েছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার মত যথেষ্ট যোগ্যতা তার এই প্রিয় ছাত্রের ছেলের হয়নি! আমি নির্বাক রইলাম। আব্বু আবার উনাকে বললো, স্যার, ও তো ঢাকা ইউনিভার্সিটিতেও চান্স পেয়েছিল। ওখানে পড়তে চায়নি। ও এঞ্জিনিয়ার হতে চায়। এরপরে উনি আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। আরেকটু সামনে অগ্রসর হতেই দাদাশ্রেণীর আরেক মুরুব্বীর দেখা পেলাম। যতদূর মনে পড়ে আব্বু উনাকে কাকা বলেই সম্মোধন করেছিলেন। আমি সালাম দিয়ে হাত মিলালাম। আবার আব্বু উনাকে আমার ভর্তির কথা বলে দোয়া চাইলেন। আব্বু এবার আগেই বলে দিলেন, যে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েও পড়িনি আর কেন সেটা করেছি। উনি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। এরপরে দাদা বললেন, ‘বাহ ভাল তো! তোমার ছেলে ম্যাট্রিক পাস করেছিল তো তাই না?’ আমার উচ্চশব্দে হাসার বাতিক আছে। সেই বাতিকে আক্রান্ত হতে যাচ্ছিলাম। সাথে সাথে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছিলাম। উনার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার পরে আব্বু আমাকে বলল, তোমার এই এঞ্জিনিয়ারিং এর ব্যাপারটা আসলে ইনারা জানেই না। সেটা আমি সেদিনও বুঝেছিলাম, আজও বুঝি। ইনাদের প্রতি আমার মনে বিন্দুমাত্র কোন খেদ নেই, আক্ষেপ নেই। উনারা বোঝেননি বলেই এমন মন্তব্য করেছিলেন।
কিছুদিন আগে আমার স্ত্রী তার এক জনৈকা আত্মীয়ার কাছ থেকে শুনলেন, বায়োলজি নাকি ‘লিপস্টিক’ সাবজেক্ট। উল্লেখ্য যে, আমার স্ত্রী বোটানি (প্ল্যান্ট প্যাথলজি) মাস্টার্স ডিগ্রিধারী। ও যখন মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছিল তখন ওকে অনেকবার শুনতে হয়েছে, তুমি গাছের ডাক্তার হবা?! এরপরে ভারী একটা হাসির হিড়িক পড়ে যেত। আমিও যে ঠাট্টা করিনি তা নয়, কিন্তু সেটা নিছক ওকে রাগানোর জন্য। বায়োলজি নিয়ে আমি কোন সাহসে মন্তব্য করি, যেখানে এই সাবজেক্ট আমি ভয়েই পড়িনি একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীতে! আমার শশুর সাহেবও আমার স্ত্রীকে বেশ কয়েকবার বলেছে, তুই কি কৃষিবিদ হবি?
এমন কথা তো আমাকেও বারংবার শুনতে হয়েছে নানা রকম বাইরের মানুষের কাছ থেকে। এবং তাদের অনেকেই আবার শিক্ষিত। জিজ্ঞাসা করেছে কিসে পড়? বলেছি, কেমিকৌশল (Chemical Engineering)। ব্যাস আর পায় কে! পরক্ষণেই শুনতে হয়েছে, ‘ও তুমি কেমিস্ট! আচ্ছা আচ্ছা বুচ্ছি!’ কেমিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি নিয়ে আমি হয়ে গেলাম কেমিস্ট! তেমনি ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স এঞ্জিনিয়ারিং বন্ধুরা হয়ে যায় ইলেক্ট্রিশিয়ান। মেকানিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং এর বন্ধুরা হয়ে যায় যন্ত্রের মিস্ত্রী আর সিভিল এঞ্জিনিয়ার হলে তো কথাই নাই। এক কথায় অনবদ্য ‘রাজমিস্ত্রী’! আমি ‘লিপস্টিক’ সাবজেক্ট এ আবার ফেরত আসছি। আমার স্ত্রী প্রথমে বুঝতেই পারে নি, বায়োলজি ‘লিপস্টিক’ মানে কি? পরে বুঝলো, আজাইরা ফ্যাশন মার্কা সাবজেক্ট বা অহেতুক ফালতু কোন সাবজেক্ট বোঝাতে এখন মহোদয়া ‘লিপস্টিক’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আমার স্ত্রী নির্বাক হয়ে গেল। তারপর জানতে চাইলো, কে বলেছে এই কথা? সেই আত্মীয়া বললো, এটা নাকি তার কোন স্যার(!) তাকে বলেছে। সায়েন্স এর সাবজেক্ট গুলা নাকি ‘লিপস্টিক’ হয়। আমার স্ত্রী যখন আমাকে এই কথাগুলো বললো, আমি কিছুটা হাসি দিয়ে কিছুক্ষণ নির্বাক ছিলাম। বললাম, আঙ্গুর ফল টকই লাগে! যাদের সায়েন্স এর কোন সাবজেক্টে পড়ার কোন যোগ্যতা নাই, তারাই এই জাতীয় আজেবাজে নোংরা কথা বলতে পারে। কোন প্রকৃত শিক্ষিত লোক কখনই ভিন্ন ডিসিপ্লিন এ পড়া কোন ব্যক্তিকে কটাক্ষ করতে পারে না। যে আর্টস বা কমার্সকে আসলেই গুরুত্ব দিয়ে পড়েছে, সে কি কোনদিন সায়েন্স এ পড়া কাউকে হেয় করতে পারে? যে সায়েন্সকে আসলেই মন থেকে পড়েছে, সে কি কখনওই আর্টস বা কমার্সকে কটাক্ষ করবে? এটা কি কোন শিক্ষিত মানুষ করতে পারে? পারে না। আমি তো মনেপ্রানে এটা বিশ্বাস করি, সায়েন্স যদি শরীর হয়, আর্টস তাহলে সেই শরীরকে জীবিত করার আত্মা। আর কমার্স হল সেই রাস্তা, এই রাস্তা ধরেই আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হয়। কোনটাকে আপনি হেয় করবেন? কোনটা ‘লিপস্টিক’?
আমার স্ত্রী তার ব্যাচেলরে অল্প কিছু নাম্বারের জন্য ফার্স্ট ক্লাস পায়নি। ওর বছর দুয়েক পরে, ওর এক কাজিন ‘সমাজ কল্যান’ থেকে ফার্স্ট ক্লাস বাগিয়ে ফেলল। দুইজনের বয়স আর ব্যাচের পার্থক্যই শুধু না, সম্পুর্ণ দুই দিগন্তের দুই সাবজেক্ট। পাঠকের নিশ্চই সেটা বুঝতে বাকী নেই। আমার শশুর তখন হসপিটালে ভর্তি স্ট্রোক জনিত কারণে। আমার স্ত্রী হসপিটালে তার বাবাকে দেখতে গেছে। আর সেই কাজিনের বাবাও গেছে হসপিটাল । উনি খুব গর্বের সাথে নিজের ‘সমাজ-কল্যান’ পড়ুয়া মেয়ের রেজাল্ট এর কথা বলতে গিয়ে খুব গর্বের সাথে আমার স্ত্রীকে বলল, ‘আমার মেয়ে তো তোমার চেয়েও ভালও রেজাল্ট করে ফেলেছে। ও ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে’। এটা শুনে অসুস্থ বাবার পাশে বসে আমার স্ত্রীর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।
আমার অনেক এঞ্জিনিয়ার বন্ধু যারা কর্পোরেট জব করে, আমাকে বলেছে, শুরুতে চাকুরীতে গিয়ে তাদের অধিনস্ত টেকনিশিয়ান বা ডিপ্লোমা বা সাব-অর্ডিনেটদের হাতে নানা ভাবে হেনস্তা করতে হয়। সবার ভাবই এমন থাকে, উনারা তো খালি বইপড়া এঞ্জিনিয়ার। উনারা আর কি জানেন? উনাদের চাইতে আমরা বেশী জানি। ইলেক্ট্রিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং এ পড়া কারো ঘরের টিভি নষ্ট হয়ে গেলে তাকে বলা হবে, এটা ঠিক করে দাও! অপারগতা জানালে বলা হবে, তাহলে আর কি ইলেক্ট্রিক্যাল পড়লা যদি একটা টিভিই সারাইতে না পারো? নতুন পাশ করা এঞ্জিনিয়ারের অধীনে কাজ করতে অনেক সিনিয়র টেকনিশিয়ানের গায়ে মনে হয় ফোস্কা পড়ে যায়। চোখ মুখের এক্সপ্রেসন দিয়ে হর হামেশা বোঝাতে থাকে, আপনি কি আমাদের চাইতে বেশী জানেন? এবার উত্তরে বলতে ইচ্ছে হয়, জ্বী হ্যাঁ! আমরা আপনাদের চাইতে বেশীই জানি। আর সেটা জানি বলেই আমরা এঞ্জিনিয়ার আর আপনি টেকনিশিয়ান। আমার ছোট খালু নিজেও একজন ইলেক্ট্রিক্যাল এঞ্জিনিয়ার। উনার একটা কথা আমার সবসময় মনে পড়ে। উনি আমাকে বলতেন, ‘তোমাকে যে যা খুশী বলুক, গায়ে মাখবা না। একজন টেকনিশিয়ান হাজার বছর সাধণা করে আসলেও একজন এঞ্জিনিয়ার হতে পারবে না’।