কক্সবাজারে আমার সমুদ্র দর্শন করতে কখনও মনে হয় না, এখানে তো আগেও কতবার এসেছি, আবার কেন? বরং যতবারই গেছি বা যেতে চেয়েছি ততবারই যেন নতুন করে ভাললাগা যোগ হয়। সমুদ্রতটে বসে সমূদ্র দেখা, ঢেউয়ের আস্ফালন, বৈচিত্র্যময় ঢেউ আছড়ে পড়ার মূর্ছনা সবকিছুই যেন অনবদ্য। অসাধারনের চাইতেও বেশী কিছু। ছোটবেলায় কানের উপরে স্টিলের গ্লাস উপুড় করে ধরে বসে থাকতাম। বাতাসের যে ধ্বনিটা শোনা যেত, বলতাম সমুদ্রের গর্জন শুনি। তখনও সমুদ্র দেখা হয়নি। আমার প্রথম কক্সবাজার সৈকত ভ্রমন হয় ১৯৯৪ সালের মাঝামাঝিতে। ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন। পুরো পরিবার একসাথে গিয়েছিলাম। তখন কক্সবাজার যাত্রার জন্য সৌদিয়া বাসের বেশ নামডাক শোনা যাচ্ছিলো। আমরাও সেই বাসে করে গিয়েছিলাম। সৌদিয়া বাসের প্রধাণ যে আকর্ষণ ছিল, সেটা হল ঐবাসে টয়লেট ছিল! বাসের শেষ মাথায় ছোট্ট একটা টয়লেট। এখন পর্যন্ত জীবনে আমি ঐ একবারই দেখেছি বাসে টয়লেট। এখন তো বাসগুলো বিভিন্ন রোডওয়ে-রেস্টুরেন্ট এ থামে। তখন এতো রেস্টুরেন্ট ছিল না। বাসের দুলুনিতে টয়লেট করা মোটেই সুখকর কিছু ছিল না, তবুও ওটাই একটা বিরাট আকর্ষণ ছিল সেই কিশোর বয়সে, বাসে টয়লেট!
কক্সবাজারে আব্বুর বন্ধু লিয়াকত আঙ্কেলের সাথে পরিচয় হয়। আমরা হোটেলে উঠলাম। যতদূর মনে পড়ে, হোটেলের নাম ছিল হোটেল শৈবাল বা এমন কিছু। হুবহু মনে নেই। লিয়াকত আঙ্কেল লইট্টা মাস ভুনা করে নিয়ে এসেছিলেন। ওই প্রথম লইট্টা মাছ ভুনা খেলাম এবং রীতিমত সেটার ভক্ত হয়ে গেলাম। লিয়াকত আঙ্কেল বেঁচে নেই। আঙ্কেলের সাথে সেই একবারই দেখা। অ্যালবামে উনার ছবি রয়ে গেছে আমাদের সাথে। মানুষ চলে যায় কিন্তু জীবিতরা স্মৃতি বয়ে বেড়ায় যতদিন বেঁচে থাকে। একজন মানুষের ঠাঁই হয় অন্য অনেকগুলো মানুষের মনে। এরপর আস্তে আস্তে মানুষ ভুলেও যায়। এটাই জীবনের অমোঘ নিয়তি। আমরা যে কয়টা দিন ছিলাম, লিয়াকত আঙ্কেল আমাদের সাথে সর্বত ভাবে সময় দিয়েছিলেন। আমাদের নিয়ে বিভিন্ন স্পটে ঘুরিয়ে বেড়িয়েছেন।
প্রথমদিন সূর্য্য দেখা মিস হয়ে গেল। ঘুম থেকে উঠতে দেরী করে ফেলেছিলাম। সমুদ্র দেখলাম। কিন্তু সূর্য্য ওঠা দেখা হল না। যদিও সূর্য্য ওঠে সমুদ্রের বিপরীত দিক থেকে। তবুও সৈকতে সূর্য্য ওঠা দেখাও কম আনন্দের না। তখন এখনকার দিনের মত মানুষ এত বেশী থাকতো না। সমুদ্রে সৈকতে হাঁটি আর নানা রকম শামুক ঝিনুক কুড়াই। হাত ভর্তি করে ফেললাম। সবচেয়ে ভাল লাগছিল ছোট ছোট মাকড়শার সাইজের ছাই রঙের কাকড়াগুলোকে। যেই আমরা কাছে যাই অমনি ঝুপ করে ওদের ছোট ছোট গর্তে ঢুকে যায়। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম ওদের একটা চিমটা আকারে বড়ো, আরেকটা ছোট! এই রহস্যের কোন কিনারা পেলাম না! এমন কেন হবে? অনেক চেষ্টা করেও কাঁকড়া গুলোকে ধরা গেল না। ঢেউগুলো যেখানে আছড়ে পড়ছিল ওখানেই হাঁটছিলাম আমরা সবাই।
দ্বিতীয়দিন আর মিস হল না। ভোরে চলে গিয়েছিলাম সমুদ্র দেখতে। সূর্য্য উঠে গিয়েছে। আমরা পাড় দিয়ে হাটছি। আমার ছোট বোনের বয়স তখন মাত্র তিন বছর। হাঁটে দৌড়ায়। সৈকতে একটা পাখি দেখতে পেলাম। নাম জানি না। খয়েরি রঙের, পা গুলো লম্বা লম্বা। বেশ আয়েশ করে হাঁটছিল সেই পাখিটা। আমার বোন আব্বুর হাত থেকে মোচড়ামুচড়ি করে নিজেকে ছুটিয়ে নিল। এরপর পাখিটাকে ধরার জন্য দিল দৌড়! ওর উদ্দেশ্য যেখেতু পাখিটা হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে, সেহেতু ও দৌড়ে সেটাকে ধরে ফেলবে। ও দৌড়ায়, সাথে সাথে পাখিটাও লম্বা লম্বা পা ফেলে হেঁটে আগে বাড়ে। যেই আমার বোন পাখিটাকে প্রায় ধরে ফেলে ফেলে, নচ্ছাড় পাখি তখনই কোত্থেকে যেন দুইটা পাখা পেয়ে গেল। ওকে হতাশ করে দিয়ে আকাশে ওর গন্তব্যে উড়ে চলে গেল। আমরা এটা নিয়ে পরে অনেক হাসাহাসি করেছি। ওকে খেপিয়েছি, কই ধরতে পারলে না তো পাখিটা? পাখি তো পাখিই, এমন কত স্বপ্নই আমরা দেখি যা হাতের নাগালের মধে ধরা দিয়েও নাগালের বাইরেই থেকে যায়।