ফাউন্টেন পেন (Fountain Pen) বা ঝর্ণা কলম আমার সেই ক্লাস ফাইভ থেকেই খুব প্রিয়। আব্বু আমাকে বলতো, যে ফাউন্টেন পেন দিয়ে লিখলে হাতের লেখা ভাল হয়। কবির সাহেব নামে এক আঙ্কেলের বাসায় একবার বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল আব্বু আমাকে। ঐ আঙ্কেলের ছেলে গভর্ণমেন্ট ল্যাবরেটরী হাই স্কুল (ঢাকা) থেকে ঐবছর বোর্ড স্ট্যান্ড করেছিল। সে নাকি দিনে ১৪ ঘন্টা(!) লেখাপড়া করেছে। এটা নাকি সে টিভি সাক্ষাৎকারেও বলেছে। ওখান থেকেই আব্বুর স্বপ্ন আমাকেও ঐ একই স্কুলে পড়তে হবে। সেই ঘটনা না হয় আরেকদিন বলবো। আঙ্কেল আমাকে বসিরে রেখে অনেক আদেশ উপদেশ দিলেন কিভাবে উনার ছেলের মত ভাল ছাত্র(!) হতে পারি। আমাকে কিছু বই পড়তে বললেন। তাঁর মধে একটা হল ডঃ লুৎফর রহমানের ‘উন্নত জীবন’ আর ‘বাণী চিরন্তনী’। দ্বিতীয় ওই বইতে বিভিন্ন টপিকের উপর বিশ্বের শত শত জ্ঞানী মানুষের নানা রকম উক্তির সন্নিবেশ ছিল। আমি যেন ওখান থেকে কোটেশন নিয়ে নিয়ে পরীক্ষার খাতায় লিখে বেশী নাম্বার(!) পেতে পারি। হাতের লেখার গুরুত্ব সম্পর্কে বললেন। ওখান থেকেই উঠে এল ফাউন্টেন পেনের ব্যাপারটা।
আমাদের ওই সময় আমরা ৩ টাকা দামের Econo Dx কলম দিয়েই লিখতাম। পরীক্ষার সময় লিখতাম Red Leaf কলম দিয়ে। ওইদিন কবির আঙ্কেলের বাসা থেকে বের হয়ে আব্বু আমাকে সোজা নিয়ে গেল একটা লাইব্রেরীতে, কিনে দিল ডঃ লুৎফর রহমানের বইটা আর বাণী চিরন্তনী! মাত্র পড়ি ক্লাস ফাইফে, ডঃ লুৎফর রহমানের জীবন দর্শণের গুরুগম্ভীর কথা বোঝার মত বয়স আমার হয়েছিল কিনা জানি না। বইটি আমি কিছু পড়েছি, কিন্তু আজ পর্যন্ত আমি শেষ করতে পারিনি। করবো হয়ত কোনদিন। তবে ডঃ লুৎফর রহমানের লেখা আব্বুর খুব প্রিয়। আমাদের বাসায় উনার লেখা সমগ্র আছে। আব্বু সময় পেলেই পড়েন। পরে কিনে দিয়েছিলেন Youth এর ফাউন্টাইন পেন দুইটা (লাল আর সবুজ রঙ) আর Pelikan কালি। ওই প্রথম আমার ফাউন্টেন পেন দিয়ে লেখা। আমার উপরে নির্দেশ ছিল এই কলম দিয়ে ভাল করে লেখা শিখতে হবে। কারণ ক্লাস ফাইভের শেষে বৃত্তি-পরীক্ষা তো আছেই। ওটা সেই ফাউন্টেন পেন দিয়ে লিখতে হবে। হাতের লেখা হতে হবে মুক্তার মত চকচকে! আমি আপ্রাণ চেষ্টা চালায়েও ফাউন্টেন পেন ভালকরে রপ্ত করে পারতাম না। পাম্প করে করে কালি ভরতাম আর সারা হাতে কালি মেখে ফেলতাম। বয়সটা যে তখন মাত্র ১১ বছর ছিল! যা হোক, বৃত্তি পরীক্ষা কিন্তু আমার ফাউন্টেন পেন দিয়ে লেখা হয়ে উঠলো না। সেই কথা আরেকদিন বলবো না হয়। ১৯৯৩ সালের পরে আমার জীবন থেকে ফাউন্টেন পেন একরকম বিদায় নিল।
২০১০ সালের শুরুর দিকের ঘটনা। প্রায় ছয় মাসের মত হল আমার ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ২০০৯ এ আমার বিয়ের মাত্র ৪ দিনের মাথায় আমার সিঙ্গাপুরের ফ্লাইট ছিল। ২০১০ এ হয়েছিল আমার বিয়ের অনুষ্ঠান যখন দেশে গিয়েছিলাম ছুটিতে। সেটা মে মাসের ঘটনা। জানুয়ারির দিকে, একদিন ল্যাব গোছাচ্ছি, হঠাৎ করে কোন এক চিপা থেকে উদ্ধার করলাম আধা বোতল নীল রঙের ফাউন্টেন পেনের কালির দোয়াত! ভাল করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলাম। বোতলে বেশ খানিকটা কালি আছে। Hero ব্র্যান্ড এর কালি। আমার মনে সেই ১৯৯৩ সাল ভেসে উঠলো। মনে আচমকা একটা মায়া জন্মে গেল ফাউন্টেন পেনের প্রতি। মনে হল, কতদিন হয়ে গেল লিখি না। আহারে এখন একটা ফাউন্টেন পেন পেলে আমি এখন এই কালি দিয়ে লিখতে পারতাম! মনে মনে ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। হাতের ধারে ফাউন্টেন পেন যে নাই। সিঙ্গাপুরে যাওয়ার পরে আমার হাতে লেখার অভ্যাসটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল প্রায়। কারণ তখন সব লেখা লিখিই যে মোটামুটি কম্পিউটারে করতে হত। আর যা সামান্য লেখালিখি ওটুক বলপেন দিয়েই সেরে নিতাম।
সিঙ্গাপুরের Mostafa Center এ পাওয়া যাওয়া না এমন জিনিস সম্ভবত মনে করাই দুষ্কর হয়ে যাবে। চলে গেলাম কলম সেকশনে। জানি এখানে আমি ফাউন্টেন পেন পাবই! পেয়েও গেলাম। দাম দেখে আমার চোখ কপালে উঠে গেল! না না! ভয় পাবেন না। ভীষণ সস্তা যে! Hero 329 এর একটা ফাউন্টেন পেন SGD $1.20 অর্থাৎ সিঙ্গাপুর ডলারে এক ডলার বিশ সেন্ট! বাংলাদেশী টাকায় মাত্র ৬৫ টাকার মত পড়ে প্রায়। আমি কিনে নিলাম সবুজ রঙের একটা কলম। কলমটা এখনও পরম যত্নে আমার কাছে আছে। আমার যখনই মন চায় আমি ওতে কালি ভরে লিখতে থাকি। যা মন চায় তাই লিখি। কলমটা এত সাবলীল ভাবে চলতে থাকে যেন মনে হয় শুধু লিখতেই থাকি! হাত এমনি এমনি চলতেই থাকে।
ভাবতে লাগলাম, এমন কিছু করি যা দিয়ে আমার লেখার সাধও মেটে আবার মোটামুটি সংরক্ষণ যোগ্য কিছুও হয়। ওদিকে আর প্রায় মাস দুয়েক পরে দেশে যাব। বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। ভাবলাম, আমার স্ত্রীর জন্য বিশাল বড়সড় একটা চিঠি লিখে ফেললে কেমন হয়? যেই ভাবা সেই কাজ। আমার সংগ্রহে একটা রাইটিং-প্যাড ছিল। জব-ফেয়ার এ গিফট পেয়েছিলাম। ফাইন্টেন পেনের নিবটা কাগজের এক কোনায় ছুঁইয়ে দেখলাম, একদম পারফেক্ট। একটুও কালি শুষে নিচ্ছে না। তাঁর মানে আমি বেশ আরাম করেই লিখতে পারবো। ব্যস শুরু করে দিলাম একটু একটু করে চিঠি লেখা। নীল রঙের কালিতে আমার স্ত্রীকে লেখা প্রথম চিঠি। যদিও প্রতিদিন ঘন্টাখানেক মোবাইল ফোনে আর Yahoo Messenger এ রুটিন মাফিক ঝগড়া করি। ঝগড়া শেষ করে আবার ফাউন্টেন পেনে চিঠি লিখতে বসি। পরে যখন দেশে গিয়েছিলাম, এয়ারপোর্ট এ নেমেই ওর হাতে আমার লেখা চিঠিটা দেই। সম্পূর্ণ প্যাড জুড়ে একটা বড় চিঠি। পুরোটাই আমার প্রিয় ফাউন্টেন পেন দিয়ে নীল কালিতে লেখা ছিল। চিঠিটা মনে হয় ওর কাছে এখনও আছে।