২১ নভেম্বর ২০১৯

আজকে আমি লজ্জার মাথা খেয়ে হলেও এমন কিছু স্মৃতির কথা বলবো, সেটা শুনে অনেকেই হয়তো বলবে, এই কাজ আমিও করেছি। ছোটবেলার কিছু খেলাধুলা, যেগুলার কথা মনে পড়লেই এখন নিজের কাছেই লজ্জা লাগে। খেলনাটা নিতান্তই সস্তা কিসিমের জিনিস ছিল। আমি লেখক নই, লেখক হবার কোন যোগ্যতাই নেই। তবু, যেহেতু নিজের জীবনের সাথে জড়িত স্মৃতি, উল্লেখ করতে অসুবিধা কি? তখন ক্লাস থ্রি ফোর এ পড়ি। ১৯৯১-৯৩ সালের দিকের ঘটনা। বছরে একবার নানুবাড়ি যাওয়া হত। খালারাও যেতেন। কাজিনরা সবাই একসাথে হতাম। দারুণ মজার একটা ব্যাপার ছিল। আমার নানুবাড়ি ভরা মানুষজন। সাধারণত শীতকালেই যাওয়া হত। ফাইনাল পরীক্ষার পরে। কানামাছি, কুমির-কুমির, ছোঁয়াছুঁয়ি, বরফ পানি, ফুল টোক্কাটুক্কি এসব খেলতাম। আমাদের সেই সময়ে ক্রিকেট এত জনপ্রিয় ছিল না। জনপ্রিয়তা যা ছিল সেটা একটু ফুটবলের। আমরা আবার লেখাপড়া(!) করা শহুরে বালক ছিলাম কিনা, তাই ফুটবলের সাথে আমাদের তেমন একটা যোগসাজস ছিল না। নানুবাড়িতে যখন যেতান তখন সবাই মিলে একটু হৈ চৈ দৌড়াদৌড়ি এই আর কি। তখন আরেকটা মজার ব্যাপার ছিল। ঈদটা পড়তো শীতকালেই।

 

ঈদে নানুবাড়ি যাবার আরেকটা আকর্ষণ কাজ করতো বিশেষ করে। কারণ আমার নানুবাড়ির ট্র্যাডিশন হল ঈদের দিন বড়রা ছোটদের টাকা দিত। দশ টাকা, বিশ টাকা করে। কপাল বেশী ভাল থাকলে পঞ্চাশ! তখন এই টাকাগুলারই অনেক দাম ছিল। নিজের হাতে একশটাকার নোট থাকলে নিজেকে রীতিমত বড়লোক বলে মনে হত। আমি আমার আমার এক কাজিন শান্ত (ছদ্মনাম) একই বয়সী প্রায়। ওর সাথে আমার রীতিমত প্রতিযোগিতা হত, কে কত টাকা কামাতে পেরেছি সেটা নিয়ে। আরেক কাজিন সীমা আপা (ছদ্মনাম) আমাদের থেকে বেশ খানিকটা বড় হওয়ার টাকা বেশী পেত। রাগে হিংসায় গা জ্বলে যেত তখন। মাঝে মাঝে কষ্টে চোখে পানি চলে আসতো যখন দেখতাম সীমা আপা কড়কড়ে একশ টাকার নোট পাচ্ছে, সেখানে আমরা মাত্র দশ টাকা! এই টাকাগুলা দিয়ে আমরা নানা রকমের উপকরণ কিনতাম। জমানোর কোন কথা মাথাতেই থাকতো না। ছোট ছোট মেটালের পিস্তল, সেগুলার বারুদের গুলি, মার্বেল, লাটিম, নানা রকমের বাজি পটকা এসব তালিকায় থাকতো।

 

একদিন শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি নানুবাড়ীর সামনের সাস্তায় আমাদের বয়সী অপরিচিত দুইটা ছেলে বেলুন(!) নিয়ে খেলছে। নানা রঙ এর বেলুন! অনেক পাতলা পাতলা! একজন আবার পানি ভরে আঙ্গুর, ছাগলের-ভুড়ি এসব ও বানাচ্ছে। আমি বললাম, কোথায় পেয়েছো এই বেলুন? ওরা আঙ্গুল দিয়ে আমাকে রাস্তার মোড়ের দোকানটা দেখায়ে দিল। জিজ্ঞাসা করলাম দাম কত? বললো, এক টাকায় চারটা পাওয়া যায়। আমি তো মনে মনে বললাম, আরে বাহ! এত সস্তা? তাহলে তো দশ টাকায় আমি চল্লিশটা এমন বেলুন কিনতে পারবো! আমাকে আর পায় কে? পকেটে ঈদের সম্বল তো ছিলই। দৌড় দিয়ে চলে গেলাম দোকানে। দুই পকেট ভর্তি করে বেলুন(!) কিনে নিয়ে আসলাম। প্রতিটা বেলুন আলাদা আলাদা করে প্লাস্টিকের কাগজে মোড়ানো ছিল। দুইটা ব্রান্ডের বেলুন আমরা সস্তায় কিনতে পেরেছিলাম। এগুলা ছিল ‘রাজা’ আর ‘সুলতান’।

 

পাঠক নিশ্চই বুঝে গেছেন? যদি না বুঝে থাকেন তাহলে আপাতত বসে বসে মুড়ি খেতে পারেন! এরপর শান্ত যখন ঘুম থেকে উঠলো, আমার কাছে এই বেলুন দেখে ওরে আর পায় কে? ও আমার মত একগাদা বেলুন নিয়ে আসলো। আমাদের সারা জগত বেলুনে কেন্দ্রীভূত হয়ে গেল। প্যাকেট ছিড়ি, বেলুন বের করি, সাবান দিয়ে ভালও করে ধুয়ে পাক-পবিত্র(!) করে এরপর দেদারসে ফুলাতে লাগলাম। আমাদের আর পায় কে? সবার সামনেই আমরা পকেট থেকে বেলুন বের করছি, ফুলাচ্ছি, আবার মাঝে মাঝে বড়দের কাছে স্টক জমা রাখছি। সবাই কেমন যেন অদ্ভুত চোখে আমাদের দিকে তাকাচ্ছিল। আমাদের এই নির্দোষ বেলুন নিয়ে খেলাও সবাই এমন বাঁকা চোখে দেখছেই বা কেন আর কেউ কেউ দেখি মুখ টিপে হাসাহাসি করছে। যদিও সরাসরি আমাদের কেউই কিছু বলছে না। কেউ কেউ বলেই বসলো, এদের বুদ্ধি হবে কবে? আমি বুঝতেই পারলাম না, বেলুন দিয়ে খেলার সাথে বুদ্ধির কি আছে?  

View shawon1982's Full Portfolio