১৮ নভেম্বর ২০১৯

পান খাওয়ার নেশা যদিও আমার নেই কিন্তু পান সামনে পেলেই আমি খাব। সামনে পাবার অর্থ দোকান থেকে কিনে খাওয়া নয়। কোন বিয়ে বাড়ীতে গেলাম, অথবা এমন কোন বাসায় বেড়াতে গেলাম, জানি যে উনারা পান খান, তাহলেই আমি উনাদের কাছ থেকে নিয়ে পান খাব। বাসায় আমার আম্মু পান খান। আমি কালে ভদ্রে উনার কাছ থেকে নিয়ে খাই। নেশা করে খাই না মোটেই কারণ পানের সাথে জর্দা খাওয়ার কোন চেষ্টা বা অপচেষ্টা কোনদিনই করিনি। মাথা ঘুরে ওঠে, বুক ব্যথা করে, ভয় লাগে! পুরানো ঢাকায় কখনও ঘুরতে গেলে ওদের যে পানের বাহারী আয়োজন, তা দেখলে কি আর না খেয়ে পারি! কত রকমের উপকরণ দিতে থাকে এক এর পরে এক। সেটা দেখাও একটা বিচিত্র অভিজ্ঞতা। ইদানিং তো আবার ‘আগুন পান’ শুরু হয়েছে। মশলা দেয়া শেষ করে দোকানী তার উপরে আগুন ধরায়ে দেয়। পরে সেই আগুন সহ পান মুখে ভরে দেয়া হয়। এই আগুনে গাল নিশ্চই পুড়ে না। পুড়লে তো মানুষ এত আগ্রহ নিয়ে খেত না। আমি আগুন পান খাইনি। দোকানদাররা পানের যে সমস্ত নাম দেন সেগুলো এক কথায় অনবদ্য। ‘বাহারী পান’, ‘বেনারসী পান’, ‘চুইংগাম পান’, ‘জামাই বৌ পান’ ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি মধ্যম দামের গুলা খেয়েছি। আর বিয়েবাড়ীতে গেলে খাওয়া দাওয়ার পরে পান না খেলে মনে হয় খাওয়াটাই অসম্পূর্ণ থেকে গেল। পানে চুন আর খয়ের দিয়ে খেলে জিহ্বা দাঁত সব লাল হয়ে যায়, সেটা আমার জন্য তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। অবশ্য পান খেয়ে যখন দেখি গাল লাল হয়ে গেছে, তখন কিংবদন্তী শিল্পী রুনা লায়লা’র গান মনে পড়ে, ‘পান খাইয়া ঠোঁট লাল করিলাম, বন্ধু ভাগ্য হইলো না’। পান খেয়ে ঠোঁট লাল করলে যদি বন্ধু ভাগ্যে জুটে যায়, বেপারটা কিন্তু মন্দ হতো না। তাহলে আমাদের দাদী নানী শ্রেণীর মুরুব্বীরা যারা আছেন, উনারা তো বেশীরভাগই নিয়মিত পান খান, উনাদের তো বন্ধু’র অভাব হত না তাহলে। আমার দাদী নানী এখন কেউ আর নেই। থাকলে জিজ্ঞাসা করতাম, তোমাদের কয়জন বন্ধু ভাগ্যে জুটেছে?

 

আমার দাদুকে আমি যখন মোটামুটি বুঝতে শিখেছি, তখন উনার গালে আর মাত্র একটা দাঁত অবশিষ্ট ছিল। পরে উনার দাঁত বাঁধাইয়ের প্রয়োজনে সেই অবশিষ্ট দাঁতটাও তুলে ফেলতে হয়েছিল সেই নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি। দাদু যখনই আমাদের বাসায় আসতেন, বা আমরা যখন গ্রামের বাড়ী যেতাম, প্রায় প্রতিবেলায় শুনতে পেতাম একটা ছান্দিক ধাতব শব্দ। চারবার করে করে এক এক দফায় বাজতো শব্দটা। ‘টুং-টুং টুংটুং’ এরপর অতি সামান্য একটা বিরতি দিয়ে আবার ‘টুং-টুং টুংটুং’। এটা হল আমার দাদীর পান খাওয়ার হামান্দিস্তাতে পান পেষার শব্দ। দাদু তো সুপারি ভাংতে পারতেন না, বা বাঁধানো দাঁত দিয়ে সেটা সম্ভব হত না। তাই উনাকে একটা কালো রঙের লোহার হামান্দিস্তায় পান পিষে পিষে খেতে হল। দাদুর এই পান পিষে খাওয়ার ব্যাপারটা আমার বরাবরই খুব প্রিয় একটা ব্যাপার ছিল। উনার এই ‘টুং-টুং টুংটুং’ শব্দ শুনলেই আমি দৌড়ে উনার কাছে হাজির হয়ে বলতাম, দাও আমি পিষি। উনার হাত থেকে নিতাম। অবশ্য উদ্দেশ্য তো অবশ্যই ছিল। উনার পেষা পানের ভাগ আমাকে দিতে হবে যে! হামানদিস্তা থেকে বের হত টুকটুকা লাল পেষা পান। তার এক চামচ আমাকে দিতেন। হাতের তালুতে নিয়ে হাতের তালুও লাল হয়ে যেত। দাদু আমার পান খাওয়া দেখে বলতেন, ‘এত পান খাইওনা দাদু, জিহ্বা মোটা হয়ে যাবে, লেখাপড়া করবা না তুমি?’ লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে ফেলেছি আরো কত বছর আগে। পান এখনও খাই। কিন্তু দাদুর মত করে তো কেউ বলে না। এখন পান ইচ্ছামত খেলেও কেউ মানা করার নেই। জিহ্বা মোটা হয়ে যায় কিনা জানি না, কিন্তু দাদুর কথাগুলো মনে পড়ে।   

View shawon1982's Full Portfolio