১৪ নভেম্বর ২০১৯

দাঁত উঠানোর আতঙ্ক শৈশবে আমার মত অনেকেরই ছিল এটা আমি মোটামুটি নিশ্চিত। আমার জন্য এই দাঁত তোলার ঘটনা এতটাই আতঙ্কের ছিল যে আমার প্রায় প্রতিটি দাঁত তোলার কথাই মনে আছে। আমার দুধদাঁত পড়ার ঘটনা শুরু হয় ১৯৮৮ সাল থেকে। তখন আমরা সৌদি আরবে থাকি। অল্প সময়ই ছিলাম। দুই বছরেরও কম। ঠিকঠাক করে যদি তারিখ বলি তাহলে ৬ই জানুয়ারী ১৯৮৮ থেকে ১৭ই নভেম্বর ১৯৮৯ সময়টা সৌদিতে ছিলাম। যাই হোক, সবার মতই সামনের দাঁত দুইটা নড়া শুরু করলো। শিরশির করতে থাকে। পরিণতি কি হতে পারে সেটা তো আর জানা ছিল না, আব্বু আম্মুকে জানিয়ে দিলাম। আব্বু যা বোঝার বুঝে গেলেন! আমাকে বললেন বারবার নাড়াতে থাকো। নাড়ায়ে নাড়ায়ে ‘তুলতুল’ করে ফেল। আমার সবকিছুই মনে থাকে কিন্তু দাঁত দুইটা নাড়ায়ে ‘তুলতুল’ করতে মনে থাকে না। দুইদিন পরে আব্বু দেখলেন, দাঁত তেমন একটা ‘তুলতুল’ হয় নাই। হালকা পাতলা বকাঝোকা শুনতে হল। আর শাস্তি স্বরুপ আমার দাঁতে সুতা বেধে দেয়া হল। সেই সুতা মুখের বাইরে বের হয়ে থাকে। কি করুণ আমার অবস্থা! এবার বলা হল, নাড়াও আর সুতা ধরে ধরে টানতে থাকো। আমিও তাই করি কিন্তু দাঁত আর আমি ওঠাতে পারি না। ততদিনে আমি নানা রকম ভয়ভীতির সম্মুখীন হচ্ছি। কারণ আব্বু বলে রেখেছে সময়মত দাঁত না ফেলতে পারলে নিচে দিয়ে দাঁত বাঁকা হয়ে বের হবে, তখন আমাকে ‘শিম্পাঞ্জী’র মত দেখাবে। আমার ঠিক বোধ হল না, আমার দাঁত শিম্পাঞ্জীর মত হলেই বা খারাপ কি? কিন্তু বুঝে গেলাম, ব্যাপারটা মনে হয় ঠিক হবে না। তাই প্রাণপণে সুতা ধরে টানাটানি করতে লাগলাম। কাজ হল না। এই অবস্থায় একদিন আব্বু কাছে ডাকলেন বেশ আয়েশ করে। আমি শর্ত দিলাম, খবরদার দাঁতে হাত দিবা না। উনি বললেন, না না দিবো না। খালি দেখবো কি অবস্থা। আমি ভাল মানুষের মত এগিয়ে গেলাম। আর উনি দেখলাম সুতাটি আঙ্গুলে পেঁচিয়ে নিয়ে বললেন, ঐ দেখ একটা কাক! আমি যেই কাক দেখতে গেলাম, উনি আঙ্গুলের এক টান দিয়ে আমার মুখ থেকে সুতা সহ দাঁত বের করে আনলেন। মাছ ঝোলানোর মত করে বললেন এই দেখ তোমার দাঁত। আমি বিস্মিত! কাঁদতেও ভুলে গেছি কারণ ব্যথা তো বুঝার আগেই দাঁত খালাস হয়ে গেছে। মুখের রক্ত ধুয়ে চকলেট খেতে বসলাম। ওটাই যে প্রধান খাদ্য ছিল তখন।

 

প্রথম দাঁত ফেলে ফোকলা হয়ে গেলাম। আমার সেই ফোকলা দাঁতের ছবি আছে অ্যালবামে। খুঁজলে হয়ত পেয়েও যাব। কি করবো এই দাঁত দিয়ে ভাবতে লাগলাম। কারণ এটা আমার ফেলে দিতে কিছুতেই মন সায় দিচ্ছিলো না। আমি ওটাকে বেশ ভালকরে সাবান দিয়ে ধুয়ে নিজের কাছে কাছেই রাখতে লাগলাম। খেলাচ্ছলে কখন যে হারিয়ে ফেলেছিলাম, সেটা আর মনেও ছিল না!  সৌদিতে থাকাকালীন আমার উপরের আর নীচের পাটির প্রায় ৫-৬ টা দাঁত এই প্রক্রিয়ায় ফেলতে হয়। পরে অবশ্য এত ভয় পাইনি। কারণ শিম্পাঞ্জী হতে চাচ্ছিলাম না। মাড়ির দাঁতগুলো অবশ্য আরো পরে শুরু হয়। তখন আমি ক্লাস থ্রি ফোরে পড়ি তখন। সৌদি আরব থেকে দেশে যখন আসি তখন আমার গজদন্ত গুলো নড়ছে। আমি নিজেই প্রাণপণ নাড়াই। রবিন ভাই (ছদ্মনাম) আমার মামাতো ভাই। একদিন দাঁত দেখার নাম করে এমন এক হ্যাঁচকা টান দিলো যে সেই দাঁত সোজা উড়ে জানালা দিয়ে বাইরে চলে গেল। আমি হতভম্ব। রবিন ভাই নির্বিকার ভাবে হাসতে লাগল। আমার এক মামী (উনি এখন আর বেঁচে নেই), উনিও আমার এক গজদন্ত ধরে এমন নাড়াচাড়া দিল যে আমার প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত হয়ে গেল। সদ্য নড়তে থাকা দাঁতটা তক্ষণই পড়লো না বটে কিন্তু একেবারে ‘তুলতুলে’ হয়ে গেল যে!

 

পরে অবশ্য আমি বীরপুরুষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলাম। আবিস্কার করেছিলাম, মাড়ির দাঁতগুলো সামনের দাঁতের মত নড়ে না। মাড়িতে কেমন যেন শিরশির করতে থাকে। ওগুলা যে কিভাবে ফেলবো ভেবেই পাচ্ছিলাম না। একদিন বেশ ভোরে উঠলাম। দেখলাম মাড়ির একটা দাঁত কেমন যেন শিরশির করছে। বুঝলাম নড়ছে। হঠাৎ করে নিজেই আঙ্গুল দিয়ে একটু চাপ দিতেই কেমন ‘কচ’ করে উঠলো। আমি হতবাক। বুঝলাম দাঁতটা উঠে এসেছে। সামান্য একটু লেগে আছে। টান দিতেই বের হয়ে আসলো। বেশ সাহস হয়ে গেল। স্কুলে যাবার আগে আরো একটা মাড়ির দাঁত আমি এইভাবেই তুলে ফেললাম নিজে নিজে। নিজেকে বাহ বাহ দিতে দিতে আমার অবস্থা অন্যরকম! আমাকে আর পায় কে? স্কুল ভ্যানে করে তখন যেতাম। স্কুলে গেলাম। বন্ধুদের কাছে গল্পের শেষ নেই। আমি নিজেই দুইটা মাড়ির দাঁত ফেলে দিয়েছি।

 

এবার আমি ভীষণ সত্যি একটা কথা বলবো, প্লিজ বিশ্বাস করুণ। একটুও বানিয়ে বলছি না কারণ আমার এই বীরত্বগাঁথা আমি কখনও ভুলতে পারিনি যে! ওইদিনই আমি স্কুলে গিয়ে উপর থেকে আরো দুইটা মাড়ির দাঁত ফেলে দেই। সর্বমোট চারটা মাড়ির দাঁত একই দিনে। দুইটা বাসায় আর দুইটা স্কুলে! আমি বাসায় এসে গল্প করতে লাগলাম। এবার বড়রা বলতে লাগলেন দুই একদিন পরে ফেলতা! আজকেই চারটা ফেলে দিলা! আমি পাত্তা দিলাম না। যা করেছি বেশ করেছি! আমার দাঁত আমি ফেলেছি! এরপরে বেশ কয়েকদিন ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজতে গিয়ে টের পেয়েছিলাম আমার এই বাড়াবাড়ি বীরত্বের ফলাফল। মাড়ি প্রায় ফাঁকা হয়ে যাওয়ায় ঠিকমত ব্রাশ করতে পারছিলাম না। যাই হোক, আমার সেই বীরত্ব যেদিন দেখিয়েছিলাম সেই তারিখটা হল ২৭সে এপ্রিল ১৯৯২। আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। প্রি-ক্যাডেট চাইল্ড কেয়ার হোমস স্কুলে!

View shawon1982's Full Portfolio