কাল কোরবানীর ঈদ। আরবীতে যাকে বলে ঈদুল-আদহা। ঈদ মানে হল আনন্দ। সার্বজনীন আনন্দ। আমার পারিবারিক আর ধর্মীয় শিক্ষা সেটাই বলে। নিজের আনন্দ কে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়াটাই তো প্রকৃত আনন্দ। কোরবানীর ঈদ আমাদের ত্যাগ, দয়া, মায়া, দানশীলতা এসবই শিক্ষা দেয়। সেটাই তো উচিত ছিল। ইসলাম ধর্মের আচার অনুযায়ী এই ঈদে কোরবানী করা সামর্থ্যবানদের জন্য বাধ্যতামুলক একটা উপাসনা (ইবাদত)। এটা কোন নিছক লোকাচার নয়, বরং ধর্মসিদ্ধ উপাসনা। কিন্তু প্রতি বছর যখন এই ঈদ নিকটবর্তী হয় তখন আমি সামাজিক মাধ্যমে আর মানুষের কথা বার্তায় নানা ধরণের রঙ দেখতে পাই। যেসন রঙের সাথে ধর্মীয় শিক্ষার কোন যোগসাজশ আমার চোখে পড়েনা। এটা আমার অক্ষমতা। আমি আর কতটুকুই জানি?
আমরা যারা নিজেদের মুসলমান বলে দাবী করি, অনেকেই ধর্মীয় আচারাদি, উপাসনা নিয়মিত পালন করেন। যেমন নামাজ পড়া দৈনিক ৫ বার। এটা বাধ্যতামূলক উপাসনা। প্রতিবার নামাজ পড়ার সময় কি আমরা ছবি দেই? বা ছবি কি দেয়া উচিত? বরং ধর্মীয় অনুশাসনে মানুষ দেখানো উপাসনা কে অত্যন্ত গর্হিত এবং অমার্জনীয় অপরাধ (শিরক) হিসাবে গন্য করা হয়েছে। রোজা রাখি। এটা কি কাউকে দেখানো সম্ভব? আর মানুষকে বলে কি হবে যে আমি রোজা রেখেছি? আমার উপাসনার মজুরী তো কেউ দেবে না, সৃস্টিকর্তা ছাড়া। সেটাই তো বিশ্বাস। যাকাত দেয়ার ছবি তো কেউ দেখায় না। তাহলে কোরবানী কি করছি না করছি সেটা মানুষকে বলে বেড়ানো বা সেটার ছবি দিয়ে মানুষকে জানানো সেটা কি খুব জরুরী? আমার বোধগম্য হয় না ব্যাপারটা। গতবার প্রশ্ন করাতে, একজন আমাকে জানালো এটা নাকি একটা আনন্দ। একটা পশুর ছবি দেয়াতে কি আনন্দ একজন শিক্ষিত মানুষ লাভ করতে পারে সেটা বোঝার মত জ্ঞান আমার নেই।
ঈদের আগে রাস্তা দিয়ে মানুষ গরু ছাগল নিয়ে হেঁটে যায়। হাজার হাজার বার জিজ্ঞাসা করা হয় দাম কত? ততবারই উত্তর দিতে হয় গরু টেনে নিয়ে আসা মানুষকে। এর পর মন্তব্য ছুড়ে দেয়া হয়, ভাই জিতসেন! আর পছন্দ না হলে মন্তব্য নেই। আচ্ছা কি দেখে মনে হল, যে উনি জিতে গেছে? গরুর দাম? নাকি চোখের কল্পনায় গরুর মাংসের আয়তন? সেই সাথে বাজার দর হিসাবে মাংসের অনুপাত? উপাসনা করে মানুষ তখনই জিতে যায় যখন সেই উপাসনা স্রষ্টার কাছে গৃহীত হয়। আর সেজন্য দরকার সততা, এবং একান্তই তাঁর জন্য হওয়া। কোরানের ভাষ্য অনুসারে, জীবন, মরণ, উপাসনা, কোরবানী সব একান্তই আল্লহর জন্য হতে হবে। সেখানে উপাসনা করে কে জিতলো আর কে হারলো সেই মন্তব্য করার আমি কে? আমার নিজের উপাসনা সৃষ্টিকর্তার কাছে গৃহীত হয়েছে কিনা, সেই চিন্তা আমি কয়বার করেছি? আমার উপার্জন বৈধ কিনা সেই চিন্তা আমি কয়বার করেছি?
আমার এক আত্মীয় সারা বছর গরু খান, মুরগী খান। কোরবানী এলে রীতিমত ঘোষণা দিয়ে দেন যে উনি কোরবানির মাংশ খাবেন না। তার কাছে এটা ‘ঘিন্না’ লাগে। খারাপ লাগে। এবং বেশ কয়েকদিন উনি হোটেলে গো-মাংস খান না। বাসায় যতদিন করবানীর মাংস থাকে উনি খাবেন না। উনাকে গো-মাংস খাওয়ানোর জন্য বাজার থেকে আলাদা গো-মাংস কেনা হয়। উনি হজ্জ করেছেন। অন্যান্য ধর্মীয় আচার কতটুকু করেন সেটা তার ব্যাপার। আমার নয়। কেমন স্ব-বিরোধী আচরণ হয়ে গেল না? যদি উনি কখনই গরু না খেতেন সেখানে আমার বলার কিছু ছিল না। কাজেই উনি যেটা করছেন সেটা প্রকাশ্যে ধর্মকে কটাক্ষ করা নয় কি? উনাকে আমি রোজার দিনে দেখেছি প্রকাশ্যে চুইংগাম চিবাচ্ছেন। আর মুখে বলছেন, আমি রোজা-টোজা রাখি না। বেশ না রাখুন। আপনার মত আপনার কাছে। মানুষকে দেখিয়ে কি বিকৃত মজা পাচ্ছেন সেটা উনিই জানেন।
প্রতিবার কোরবানীর ঈদ আসে আর সামাজিক জোগাযোগের মাধ্যম গুলোতে বাকযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। কোরবানীর পক্ষে বিপক্ষে কত যুক্তি কত তর্ক! ধর্ম আর মনুষ্যত্ব কি তর্ক দিয়ে হয়? ভালবাসা কি তর্ক দিয়ে জেতা যায়? তারপরেও আমরা বাকযুদ্ধে লিপ্ত হই। অন্যের ধর্মকে ছোট করে নিজের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য আমার জান প্রাণ দিয়ে লেগে যাই। ভুলে যাই ধর্মের শিক্ষা কি ছিল। মুসলমান হিসেবে, নবীর শিক্ষাকে বেমালুম ভুলে বসে থাকি। এমনভাবে মানুষকে হেয় তুচ্ছ করতে থাকি যেন আমি নিজেই নতুন কোন এক ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করতে চলেছি। আমি অনেক জানি! কিন্তু আমি কতবার ভেবেছি আমি আসলে কত তুচ্ছ? কত কম জানি?
একজন লোক, যার আচার আচরণে আমি তাকে ধার্মিক বলেই মনে করতাম, অন্তত পোষাকে। সে লিখলো “আগামীকাল হিন্দু ভাই দের আমার বাসায় গরু খাওয়ার দাওয়াত”। দেখে ঘৃণায় মন বিষিয়ে গেল আমার। উত্তর দিলাম, আপনার কাছ থেকে আমি এমন কথা আশা করি নাই। উনি লিখলেন, ‘হিন্দুরা তো প্রসাদ খাওয়ার দাওয়াত দেয়, আমি দিলে কি দোষ?’ এবার আমি আপনাদের বলছি, আমার এই বয়সে, কম তো হল না, হিন্দু বন্ধু, পরিচিত লোক অনেকের সাথেই আমার সখ্যতা উঠাবসা আছে। কই আজ পর্যন্ত তো কেউ আমাকে কোনদিন “প্রসাদ” খাওয়ার দাওয়াত করেনি। ভদ্রলোক তার জ্ঞানের অভাবে প্রসাদ আর সাধারণ দাওয়াত কে গুলিয়ে ফেললে আমার কিছু যায় আসবে না, কিন্তু উনি উনার মত কতিপয় জ্ঞানীর(!) কাছ থেকে বাহবা পাচ্ছেন আর প্রতিহিংসাত্মক কথাকে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। “ধর্ম যার যার উৎসব সবার” এই কথা অপব্যাখ্যা করা হচ্ছে। মুসলমানদের কে বলেছে হোলিতে গিয়ে রঙ খেলতে? কে বলেছে পুজা মন্ডপে যেতে? মাথায় সিঁদুর দিতে? কোন হিন্দু কি কোন মুসলমানকে জোর করে এসব করতে বলেছে? অন্তত বাংলাদেশে? তাহলে আপনি কেন যাচ্ছেন? কেন করছেন? আর সেটার জন্য পালটা আপনি কেন, একজন হিন্দুকে গরুর মাংসের খেতে আসার কথা বলছেন? সে গরু খাবে কি না খাবে সেটা তার অভিরুচি। পুজায় আমি বহুবার হিন্দু সুহৃদের বাড়িতে দাওয়ার পেয়েছি, খেয়েছি। আপনারা বলুন তো, ঈদে ক’জন হিন্দুকে আন্তরিক ভাবে দাওয়াত দিয়েছেন? আপনি কোরবানীর ঈদেও তো তাদের দাওয়াত দিতে পারেন। সেটা গরু খাওয়ার জন্য কেন? আপনি তাদের জন্য কি এমন খাবার রাখতে পারেন না সেটা তারা আনন্দ করে খেতে পারে? আসলে আমরা অনেক সংকীর্ণ। সঙ্কীর্ণতার মধ্যে সুখ নেই; উদার হওয়াতেই আনন্দ। আমার এক হিন্দু বন্ধু তার বিয়ের দাওয়াত দিয়েছিল। গেলাম তার বাড়ী। আমাকে সে জানালো, দোস্ত, তুই নিশ্চিন্তে খাসী, মুরগী খা। কারণ আমাদের মিনন্ত্রণে অনেক মুসলমান গেস্ট আসবেন। বাবা সব কিছু মুসলমান দোকান থেকে, মুসলমান কসাইয়ের কাছ থেকে নিয়েছেন। সেদিন আমি কিছুটা হলেও শিখেছিলাম উদারতা কাকে বলে।
আমাদের গ্রামে ফেব্রুয়ারী মাসে হিন্দুদের মহানাম যজ্ঞ অনুষ্ঠান হয় তিন দিন ব্যাপী। ২৪ ঘন্টা কীর্তন চলে আর সেই সাথে চলে ধর্মীয় আলোচনা। প্রত্যেকেই আমন্ত্রিত। গ্রামের গন্যমান্য মানুষ হিসাবে আমার বাবার যথেষ্ট সুনাম আছে। উনিও একজন আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন। আমার বাবা-মা সেখানে যাওয়া পাত্র পুজা কমিটির লোক উঠে এসে, উনাদের অতি সন্মানের সাথে ভি-আই-পি মর্যাদা দিয়ে প্রথম সারির অতিথি আসবে বসাল। আমি গিয়েছি দুইবার। আলোচনা শুনেছি। দেখতে গিয়েছি কি হয়, সার যাথেই দেখা হয়েছে, সেই আমাকে আসন দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে গিয়েছে, আর বার বার বলে গিয়েছে, আমি যেন না খেয়ে না যাই। না ভাই, সেটা প্রসাদ ছিল না। সেটা অতিথিদের জন্য রান্না খাবার ছিল। আমি জানি প্রসাদ কাকে বলে আর দাওয়াত কাকে বলে। আমি এও জানি, আমাদের মহানবী ইহুদীর বাড়িতে দাওয়াত গ্রহন করেছেন। পৌত্তিলিকদের সাথে বসে একত্রে অতি আদরের সাথে তাদের আহার করিয়েছেন। মহাযজ্ঞে যে আলোচনা হয়েছে, তার মধ্যে আমি এমন একটা শব্দ পাইনি যেখানে মুসলমানদের কটাক্ষ করে কিছু বলা হয়েছে বা তুচ্ছ করা হয়েছে। তাহলে আমাদের ওয়াজ মাহফিল গুলাতে কি হয়? ওয়াজ মাহফিলে কোন হিন্দু অতিথিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়? হিন্দুরা তো তাদের পুজাকে “সার্বজনীন দুর্গোৎসব” বলে। আমরা কেন আমাদের ওয়াজ গুলোকে “সার্বজনীন ওয়াজ” করতে পারি না? সমস্যা কোথায়? কেন ওয়াজের মধ্যে নিজের ব্যক্তিগত গুনকীর্তন করতে হবে আর অন্যধর্মকে কটাক্ষ করতে হবে? অন্যকে ছোট করে, হেয় করে, অপমান করে কি নিজে বড় হওয়া যায়?
আমি সেই ধর্মকেই শিখতে চাই, যেখানে প্রকৃত মহানবীর শিক্ষা ছড়ানো হবে। সার্বজনীন ভালবাসার শিক্ষা দেয়া হবে। আমি নবীর শিক্ষায় শিক্ষিত হতে চাই। মানুষের জন্য উদার হতে চাই। নবীজী নিজের গায়ের চাদর যেখানে পৌত্তলিকের বসার জন্য বিছিয়ে দিয়েছিলেন। শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে। পরিশেষে বলতে চাই, আমার শত্রু-মিত্র, আস্তিক-নাস্তিক, ধার্মিক-অধার্মিক সবার জন্যই আমার ভালবাসা রইলো। সবার জন্য আমার, আমার ঈদের শুভেচ্ছা রইলো।