বৃত্তিপরীক্ষা এবং একটি ওয়াকম্যান

সিঙ্গাপুরে ছিলাম তখন। মাঝে মাঝে ফ্যারার পার্কে ঘুরতাম। নানা রকম দোকান। শখ করে এটা ওটা কিনতাম। বেশীরভাগই দেশে পাঠানোর জন্য। অন্যদের গিফট দেয়ার জন্য কেমন যেন একটা ভালোলাগা কাজ করতো। সেই মনটা এখনও আছে। কিন্তু প্রেক্ষাপট অনেক বদলে গেছে। সিঙ্গাপুরে বিভিন্ন জায়গায় এমন দোকান আছে। নাম ABC shop! ওখানে এক দুই ডলার থেকে শুরু করে অনেক অনেক কম মূল্যে নানা রকম গিফট আইটেম পাওয়া যায়। আমি ২০০৯ সালের দিকের কথা বলছি। স্মার্ট ফোনের চল শুরু হয়েছে তখন একটু একটু। দোকানটায় ঘুরছি। চোখ আটকে গেল একটা জিনিসের দিকে। সেই জিনিস আমাকে মুহুর্তের মধ্যে ১৯৯৩ সালে টেনে নিয়ে গেল। যখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। জিনিসটার নাম “ওয়াকম্যান”। আশির দশক আর নব্বইয়ের দশকের সঙ্গীতপিপাসুদের মোটামুটি কাঙ্খিত বিলাসদ্রব্যের একটি ছিল। বর্তমান জেনারেশনের কাছে জিনিসটা বোধগম্য নাও হতে পারে। এটি ছোট একটি ক্যাসেট প্লেয়ার! হেডফোন দিয়ে গান শোনা যেত। নব্বই এর দশকের শুরুতে টিস-টাস ফ্যাশন দেয়া ভাইয়া আপুদের দেখতাম ওয়াকম্যানে গান শুনতো। ওগুলো আমাদের বয়সীদের জন্য ভয়ঙ্কর নিষিদ্ধ জিনিস ছিল। থ্রি ফোরে পড়া ছেলেমেয়ে আবার গান শুনবে কি? গান শুনবে শুধু বড়রা! ওটা বড়দের জিনিস।

 

হাতে নিয়ে ওয়াকম্যানটা দেখছি। উলটে পালটে দেখছি। ২০০৯ সালের কোন ছেলেমেয়েই তো আর ক্যাসেটে গান শোনে না। ইউটিউব চলছে, সবার হাতে হাতে মোবাইল, mp3 প্লেয়ার, আই-পড এসব! ক্যাসেটের ওয়াকম্যান জিনিসিটা বাতিল হয়ে গেছে ৯০ এর দশকের শেষের দিকেই যখন মানুষ সিডিতে গান শোনা শুরু করলো। তখন কিছুদিন চললো ডিস্কম্যান! সিডি চালানো ওয়াকম্যান আর কি। আমি দাম দেখলাম, মাত্র ১.৯ সিঙ্গাপুরি ডলার মাত্র। হাট একটা পকেটে চলে গেল। ওয়াকম্যান কিনবো বলে। মনে পড়ে গেল পুরানো কথা। আবার শেলফে রেখে দিলাম ওটা। কি হবে কিনে? দোকান থেকে বের হয়ে আসলাম।

 

১৯৯৩ সালে ফাইভে পড়ি। বৃত্তি পরীক্ষা বলে ছিল কিছু একটা। সেটার বর্ননা দিতে চাই না। সবাই মোটামুটি জানে। আমি ছাত্র কেমন ছিলাম সেটা আমার বিবেচ্য না। কিন্তু আবার বাবা-মা হয়ত আমাকে নিয়ে অনেক আশাবাদী ছিলেন। সারা বছর আমাকে শোনানো হতো আমাকে বৃত্তি পরীক্ষা দিতে হবে এবং বৃত্তি পেয়ে দেখাতে হবে। আমাকেও এও বলা হল, বৃত্তি পেলে অনেক টাকা পাওয়া যায়! আমি খুব একটা বুঝতাম না, আসলে টাকাটা দিয়ে আমি কি করবো? টাকার গুরুত্ব না থাকলেও, বৃত্তি পরীক্ষা যে অনেক বড় কিছু সেটা মাথায় ঢুকে গিয়েছিল। মনের মধ্যে তখন একটা ওয়াকম্যানের মোহ অনেকদিনের ছিল। কাকে যেন দেখেছিলাম, কোমরের বেল্টে ওয়াকম্যান ঝুলিয়ে, চোখে কালো সানগ্লাস দিয়ে, নীল জিন্সের প্যান্ট আর ইন ছাড়া শাদা শার্ট পরে মাথায় তাল দিয়ে দিয়ে গান শুনছে! ছবিটা মনে গেঁথে গিয়েছিল। আমাকেও ওইরকম হতে হবে! যে করেই হোক একটা ওয়াকম্যান কিনতেই হবে আমাকে।

 

একদিন সুযোগ বুঝে, বাবার মুড খুব ভাল আছে মনে করে আস্তে আস্তে করে বলেই ফেললাম, ‘আব্বু, আমি যদি বৃত্তি পাই, আমাকে একটা জিনিস কিনে দিবা?’

আব্বু হেসে বললো, ‘কি চাও? কি লাগবে?’ আমি বললাম, ‘আমি যদি বৃত্তি পাই, আমাকে একটা ওয়াকম্যান কিনে দিবা?’। একটুও সময় কালক্ষেপণ না করে বাবা বলেছিলেন, ‘তুমি যদি বৃত্তি পাও, তাহলে আমি তোমাকে ওয়াকম্যান কিনে দিব’। আমার সারা পৃথিবী ওলট পালট হয়ে গেল খুশিতে। যে করেই হোক একটা ওয়াকম্যানের জন্য আমাকে বৃত্তি পেতেই হবে। বৃত্তি পরীক্ষা এসে গেল। দিলাম। কাঙ্খিত বৃত্তি পেয়ে গেলাম। একেবারে ট্যালেন্টপুল ফার্স্ট হলাম সেন্টারে। আমার বাবার আনন্দের সীমা নেই। কয়েকটা পেপারে পর্যন্ত উনি আমার ছবি সহ ছাপিয়ে দিলেন। ক্লাস সিক্সে ভর্তি হলাম ভর্তি পরীক্ষার ভয়ঙ্কর অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে। এটাও আমার বাবার স্বপ্ন ছিল। যেন আমি ওই স্কুলে পড়ি। হলাম ভর্তি। হাই স্কুলের জীবন শুরু হল। ওয়াকম্যানের কথা ভুলিনি। আমার সেই অতি আরাধ্য, জীবনের সাধনা সেই পুরস্কার।

 

একদিন আবার বাবাকে বললাম, ‘আব্বু আমাকে কিনে দিবা না?’। উনি এবার বেশ কিঞ্চিত অবাক হলেন। বললেন, ‘কি কিনে দিতে হবে?’। আমি বললাম, ‘কেন তুমি না বলেছিলে, আমি বৃত্তি পাইলে আমাকে ওয়াকম্যান কিনে দিবা? দাও কিনে’। বাবা এবার আগের চেয়েও ওবাক হয়ে এবং কিছুটা রাগত স্বরে বললাম, ‘কবে বলসি আমি এই কথা? ওয়াকম্যান কবে কিনে দেব বলসি?’ আমি কাঁদো কাঁদো স্বরে অনেকবার মনে করায়ে দিতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু উনি আর কিছুতেই মনে করতে পারলেন না যে উনি আদৌ আমাকে কিছু প্রতিজ্ঞা করেছিলেন কিনা।

 

এবিসি দোকানের কথা মনে আছে তো আপনাদের? শুরুতে বলছিলাম? আমি তখনও সিঙ্গাপুর। যতবার ঐ দোকানে গিয়েছি, ততবার ওয়াকম্যানটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি। আবার তাকে রেখে দিয়ে চলে এসেছি। অজানা একটা বাষ্প কোথা থেকে এসে যেন আমার দৃষ্টি ঝাপ্সা করে দিত। চোখের দৃষ্টি যেন ঠিক হয় যায়, এজন্য খুব দ্রুত অন্য কিছু কেনার থাকলে কিনে দোকান থেকে বের হয়ে যেতাম।

Author's Notes/Comments: 

13 june 2019

View shawon1982's Full Portfolio