ফিতাকৃমি

একটা সময় ছিল, সেই ৯০ এর দশকের কথা, প্রেম জিনিসটাকে ভীষণ নিষিদ্ধ একটা “বড়দের জিনিস” হিসাবে ধরা হত। তখন স্কুলে পড়তাম। বই খাতা ডায়রী বা কোথাও ‘হার্ট’ এর স্টিকার লাগানো থাকলে অথবা কলম দিয়ে ‘হার্ট’ শেপ আঁকানো থাকলে বড়রা যেই দৃষ্টিতে তাকাতো, জবাবদিহিতা করতো সেটা টর্চার সেল থেকে কোন অংশে কম ছিল না। অবশ্য তখনকার দিনে প্রেম করলে, বইয়ের মধ্যে হার্ট এঁকে তীর দিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে দুইজনের নামের আদ্যক্ষর ইংরেজীতে দেয়া, নিষিদ্ধ প্রেমের স্বীকৃতি দেয়ার মত একটা ব্যাপার ছিল। নাইন টেন পড়ুয়া কোন ছেলেমেয়ের কাছে এসব পাওয়া গেলে তাকে নির্ঘাত ভীষণ রকমের মার খেতে হত। আমার ধারণা ছিল, নাইন টেনে উঠলেই ছেলে-মেয়েরা এসব নিষিদ্ধ প্রেমে জড়িয়ে যায়। যে করেই হোক আমাকে এসব থেকে দূরে থাকতে হবে। কারণ আমি যে ভালো ছেলে হতে চাই! বই খাতায় কোথাও হার্ট শেপ আঁকা থাকলে তাই নিয়ে বড়রা এমনভাবে কানাঘুষা করতো যেটা চিন্তা করলে এখনও পিলে চমকায় যায়। তিলকে তালা করা নিত্য দিনের ব্যাপার ছিল। সেই সাথে চিঠি লিখে প্রেম তো ছিলই। এখনকার ছেলেমেয়েরা অবশ্য এসব শুনলে ঠোঁট বাকা করবে বললে, উফ শিট! ইঊ  গাইজ আর ঠু ব্যাকডেটেড!

 

প্রেম আমার জীবনে ভীষণ রকমের ‘কুৎসিত’ একটা জিনিস ছিল। ফ্যামিলি থেকে অন্তত আমার মন মানসিকতা সেভাবেই গড়ে তোলা হয়েছিল। নিজেকে চেষ্টা করতাম এই ‘কুৎসিত’ বস্তু থেকে দূরে থাকতে। প্রাইমারী কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়ার সময়, নাইন টেন পড়ুয়া ভাইয়ারা আপুদের সাথে কথা বললেই, এমন বাঁকা চোখে দেখতাম তাদের, যে সর্বনাশ হয়ে গেছে। ওই ভাইয়া ওই আপুর সাথে কথা বলতেসে, তার মানে শিওর ওরা ‘প্রেম’ করতেসে। তখনকার দিনে কো-এডুকেশন মানেই বাজে একটা ব্যাপার, প্রেমের আখড়া, ছেলেমেয়ের নিশ্চিত গোল্লায় যাওয়ার মত একটা ব্যাপার ছিল। কো-এডুকেশন শুনলেই খারাপ লাগতো! না বাবা! আমি জীবনেও ওইসব স্কুলে পড়বো না। যদি খারাপ হয়ে যাই? স্কুলে পড়ার দিনগুলোতে, বাংলা বা সর্বোচ্চ হিন্দী গান ক্যাসেটে শোনার একটা চল ছিল। ইংলিশ গান শোনা মানেই হল হয় প্রেম করতেসে আর না হয় বখাটে হয়ে গেছে বাজে হয়ে গেছে, নেশা করতেসে ইত্যাদি। ওয়াকম্যান বলে যে জিনিসটা ছিল, আমার ধারনা ছিল ওটা কিনতে হলে ভীষণ রকম বড়লোক হওয়া লাগে, আর সাথে জিন্স এর প্যান্ট, চোখে কালো সানগ্লাস পরতে হয়। তাই আমার ওসব ভাগ্যে জোটেনি। আমি জিন্স এর প্যান্ট প্রথম পরি ১৯৯৭ সালে, স্কিন-টাইট জিন্স, তাও আমার এক মামাতো বোনের বিয়েতে। কত রাত আমার নির্ঘুম কেটে গেছে এই চিন্তায় যে, আমি আমার ওই বোনের বিয়েতে জিন্সের প্যান্ট পরব! আহারে আমাকে কত না জানি নায়কের মত দেখাবে! আহারে স্বপ্নের জিন্সের প্যান্ট!

 

১৯৯৭ সালে আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। শুরু থেকেই একটা কোচিং সেন্টারে পড়তাম এবং ‘ভালো’ ছাত্র হিসাবে আমার বেশ সুনাম ছিল। আমি অন্যদের তুলনায় একটু ‘ফ্রিলি’ মেয়েদের সাথে কথা বলতে পারতাম। সেই সুবাদে আমার কিছু ‘মেয়ে’ বান্ধবী তৈরী হয়ে গিয়েছিল। ক্লাসে অন্যছেলেরা যারা ছিল, তারা মনের ভুলেও ‘মেয়েদের’ সাথে কথা বলতো না, বা বলার প্রয়োজন হত না তাদের। কোচিং এর ক্লাসেও একটা শ্রেণী বৈষম্য তৈরী হয়ে যেত। ওরা ভাল, অন্যরা গরু গাধা! অন্য কেউ আমার চেয়ে নাম্বার বেশী পাবে? উহু তা হবে না! কেন পেল, কি জন্যে পেল, আচ্ছা পরের বার দেখে নেব, এই ধরণের একটা ব্যাপার ছিলই।

 

একদিন আব্বুর অফিসে এক আন্টির সাথে দেখা। বেশ আধুনিকা। আব্বু পরিচয় করিয়ে দিলেন। আন্টি আমার কাছে জানতে চাইলেন কোথায় পড়ি, কোন কোচিং এ পড়ি ইত্যাদি। সব বললাম। পরেরদিন কোচিং এ গিয়ে দেখি ঐ আন্টির দেখা। উনি বললেন, আমার মেয়েকে তোমাদের ব্যাচ এ ভর্তি করিয়ে দিয়েছি। আমি ও আচ্ছা বলে ক্লাসে ঢুকে গেলাম। সবাইকে চিনতাম ভালো মতই, কাজেই নতুন যে ভর্তি হয়েছে তাকে খুঁজে পেতে কোন বেগ পেতে হল না। বছরের মাঝে ভর্তি হল সে। পোশাকে আশাকে সেও তার মায়ের মতই আধুনিকা। এক কর্নারে বসা ছিল। আমি যেহেতু ফার্স্ট বেঞ্চে বসতাম, মেয়েটার পাশের বেঞ্চ ফাকা ছিল। ওর পাশে গিয়েই বসলাম। একটা ‘মেয়ে’র পাশে বসতে অন্যারা জড়তায় যেখানে মরে যেত, সেখানে আমি বেশ সাবলীল ছিলাম। আমি মেয়েটাকে বললাম ‘হাই’! সেও আমাকে হাসিমুখে সুন্দর করেই উত্তর দিল। নাম জিজ্ঞাসা করলাম, বললো তানিয়া। সাথে আর কিছু ছিল কিনা আমার মনে নেই। কোন স্কুলে পড়তো সেটাও আমার আর মনে পড়ে না। টুকটাক কথা বলতে লাগলাম মেয়েটার সাথে।  আমি এক পর্যায়ে বললাম, তোমার তোমার নাম তানিয়া? তানিয়া মানে তো ‘ফিতাকৃমি’। একথা বলার কারণ হল, তখন নয়া নয়া বায়োলজি পড়ছি। বইতে দ্বিপদী নামকরণে পড়েছি, ফিতাকৃমির বৈজ্ঞানিক নাম হল Tenia Solium. ঐ বিদ্যা ঝেড়ে দিলাম।

দেখলাম, মেয়েটা একটুও রাগ তো করলোই না বরং বেশ হাসলো ব্যাপারটা নিয়ে। আমার ধারাণা ছিল ক্ষেপে যেতে পারে। এরপরে মনে হয় উইকেন্ড এর ছুটি ছিল। এরপর আবার কোচিং এর ক্লাসে যখন শুরু হল তখন আমার জন্য চরম বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। যথারীতি তানিয়া সামনে বসা। আমিও ফার্স্ট বেঞ্চে বসতেই, তানিয়ে ওর হাতের তালু খুলে মেহেদির নকশা দেখালো। নকশাটা আক্ষরিক অর্থেই একটা ফিতার মত পেচানো কোন ডিজাইন ছিল। যা দেখেই আমার প্রথমেই আবার ফিতাকৃমি’র কথা মনে হল। তানিয়া বললো, এই দেখো, আমি মেহেদি দিয়ে ফিতাকৃমি এঁকেছি। কেমন হয়েছে? আমি বললাম, ভালোই তো। তুমি এই ডিজাইন করতে গেলে কেন? তানিয়া হাসি হাসি মুখে বললো, করলাম, তুমি বলেছো আমার নাম নাকি ফিতাকৃমি, তাই এই ডিজাইন করলাম।

 

তানিয়া খুব বেশীদিন ঐ কোচিং এ পড়ে নাই। বিনা নোটিসে একদিন নাই হয়ে গেল। আর ওর কোন খবর পেলাম না। আর কখনো দেখাও হয় নাই কোনদিন। এখন দেখা হলে আর হয়ত চিনতেও পারবো না। কিন্তু আমি মাত্র একবার বলাতে একটা মেয়ে খুব সহজেই তার হাতে মেহেদি দিয়ে ফিতাকৃমির ডিজাইন করে ফেলেছিল, এই স্মৃতি মনে হলে আজও অন্যরকম লাগে। এই রহস্যের কোন কারণ বা ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই।    

Author's Notes/Comments: 

25 november 2018

View shawon1982's Full Portfolio