একটা ছেলের জীবনের ‘অনেক’ কিছুই কেন যেন ধর্তব্য হয় না। সেটা বড়ো মাপের কিছু হলেও ভুলে যাওয়া টা মনে হয় অনেকের জন্য অনেক সহজ। বেশীরভাগ মানুষ এসব তো ‘গা’ ই করেন না। ভাবখানা এমন যে, ও তো ছেলে! এ আর এমন কি? সুতরাং, যেহেতু ছেলে হয়ে জন্মানো হয়েছে, সেহেতু তাকে ‘বাই ডিফল্ট’ ‘সর্বংসহা’ হতে হবে, তাতে তার জীবনে ‘লেহ্য-পেয়’ কিছু থাকুক বা না থাকুক। একটা ছেলের জিবনের উপাখ্যান কোন সাহিত্যিকের কাছে চুম্বকের মত কোন কিছু মনে হয় কি? আমার জানা নাই। একজন নারীর জীবনের সংগ্রাম, নারীর দেহ, নারীর হাসি, নগ্নতা, যৌনতা, কামনা, বাসনা, হাসি সবকিছুই একজন কবির ব্রহ্মাস্ত্র। কুবের-কপিলা আলোচনায় আসলে ‘কপিলা’ প্রসঙ্গই আলোচনা গ্রাস করে ফেলে, ‘কুবের’ চলে যায় আস্তাকুড়ের আবর্জনায়। ‘নারী’ নিয়ে লেখালিখির ব্যাপারে কার কোন ক্লান্তি নেই। চলছে তো চলছেই। চলুক, আমি আপত্তি করছি না, কিন্তু যদি অনুপাত ধরা হয় সেই তুলনায় ছেলেদের নিয়ে, বা ছেলেদের জীবনের উপজীব্য নিয়ে কতটুকু লেখা হয়েছে? সেই ব্যাপারে আপনারাই আমার চেয়ে ভালো জানেন। আমি তেমন কিছু জানি না। এটাকে আমি সম্পূর্ণ আমার নিজের সীমাবদ্ধতা এবং জানার ত্রুটি হিসেবে ধরে নিচ্ছি। নারীবাদী লেখার জন্য সাহিত্যিকরা নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন। ‘পুরুষবাদী’ লেখক বলে কি আদৌ কিছু আছে?
আমার প্রবাস জীবনের টুকরো টুকরো কিছু ভাঙ্গা কাঁচের টুকরো আপনাদের সামনে জোড়া দেওয়ার একটু অক্ষম চেষ্টা করছি। একরাতের কথা। আমি এবং আমার স্ত্রী একটা ‘দীঘি’র (ওয়াটার রিজার্ভয়ার) এর পাশে দিইয়ে হাটতে হাটতে লক্ষ করলাম, একজন বাংলাদেশী লোক উচ্চস্বরে কথা বলছে। বেশ উত্তেজিত এবং সে জোরে জোরেই কথা বলছে। কিছু কিছু দূরত্বে বসার বেঞ্চ ছিল। আমরা গিয়ে বসলাম। লোকটাও আমাদের থেকে অদূরে অন্য বেঞ্চে বসে কথা বলছিল। রাত ছিলো, কোলাহল ছিল না, তাই উনার কথা মোটামুটি ভালোই শোনা যাচ্ছিল। লোকটা কথা বলতে বলতে একসময় কেঁদে ফেলল। তার কান্না মিশ্রিত কন্ঠের কথার সারমর্ম যা বুঝেছিলাম তা হল, লোকটি একজন খুব সাধারণ মানের নির্মান শ্রমিক। খুব সামান্য কিছু টাকা পায়, এবং দেশ থেকে তাকে ক্রমাগত টাকার জন্য বারনবার চাপ দেইয়া হচ্ছে। লোকটি বলছিল, ‘মা এই টাকা এখন আমি কোথা থেকে পাব? কই থাকি কি করি তুমি কি কিছু জানো? আমার কত টাকা ধার-দেনা হয়ে গেছে’। আমার যা বোঝার ছিল বুঝে গেলাম। প্রবাসী একজন শ্রমিকের ‘খুব কিঞ্চিত’ কিছু কথা যা কারো ধোপে টিকবে না। কখনও টেকেও না। আমাদের দেশের গ্রাম থেকে বা কোন গরীব ঘর থেকে আসা একজন প্রবাসী শ্রমিক তার পরিবারের ধারণা মতে ‘টাকার’ মধ্যে বসবাস করা ‘বড়লোক’ টাইপ কিছু। এদের কোন অভাব, দুঃখ, অসুখ, মন খারাপ, কোন কিছুই হয় না। আপনারা এটিএম ম্যাশিন তো দেখেনই। প্রবাসী শ্রমিকরা হলো ‘এসি’ ঘরে শুয়ে-বসে থাকা এটিএম ‘ম্যাশিন’। ম্যাশিনই তো! এদের আবার সমস্যা কি? এদের কি ভাত খাওয়ার কোন দরকার আছে?
একজন পরিচিত বাংলাদেশী ভাইকে মসজিদে দেখেছিলাম খুব মন খারাপ করে বসে আছে। উনিও একজন শ্রমিক ছিলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম ভাই কি হয়েছে? উনি আমাকে যা বলেছেন তার নির্যাস হল, উনার বড় ভাই দেশে পুকুর কাটবেন, মাছ ছাড়বেন, এজন্য বড় ভাই আর মা টাকা চেয়েছেন। বারবার তাকে চাপ দিচ্ছেন। আমি বললাম, ভাই আপনার না কয়েকদিন আগে একটা ছেলে হয়েছে? আপনার স্ত্রী আর বাচ্চা কই থাকে? বললেন, বৌ-বাচ্চা নিয়ে তার বাপের বাড়ি চলে গেছে। আমিই চলে যেতে বলেছি। কারণ মা আর ভাই টাকার জন্য একজন ‘প্রসূতি’ মা-কে নিয়মিত কথা শুনায়, চাপ দেয়। চাপ তো দিতে হবেই, এটিএম ম্যাশিন এর পাসওয়ার্ড যে ‘তাদের’ হাতে। আমি উনার হাত ধরে বললাম, ভাই! অনেক করছেন (আমি উনাকে বেশ কিছুদিন ধরেই চিনতাম) ফ্যামিলির জন্য। এখন আপনার নিজের বাচ্চা হয়েছে। দয়া করে বাচ্চার কথা একটু ভাবেন। কয়দিন পর দেশে চলে যাবেন, দেশে গিয়ে নিজের কিছু করার কথা চিন্তা করেন। এভাবে বড় ভাইএর পুকুরের মধ্যে নিজের টাকা ফেলে দিলে আর কি থাকবে?
এবার বলি আমার খুব কাছের একজন মানুষের কথা। আমার আত্মীয় বলতে পারেন। বিদেশে থাকাকালীন একটা সময় তার খুব কষ্টের মধ্যে দিয়ে গেছে। ছয় মাসের মত প্রায় তার হাতে তেমন কোন টাকা ছিল না। এমন কি খাওয়ার মত যথেষ্ট পয়সাও ছিল না। আমি তাকে বলেছিলাম, ভাই আপনার এই অবস্থা কে জানে? উনি বলেছিলেন শুধু আমার স্ত্রী জানে। কেন, আপনার বাবা-মা? তাদের কে বললেই তো পারেন। উনারা তো আর্থিক ভাবে সমস্যায় নাই, আপনাকে হেল্প করতে পারে। উনি জানালেন, না ভাই, বাবাকে কিছু বলি নাই। বাবা ব্যবসা নিয়ে ঝামেলায় আছেন। হাতে টাকা পয়সা তেমন নাই। এখন আমি আমার কথা জানালে এই টাকা দিতে উনার কষ্ট হবে। আমি আমার স্ত্রীকেও মানা করে দিয়েছি কিছু না জানাতে। দেশে আসার পরে আমি সেই লোকের সাথে একদিন আবার আলাপ করেছিলাম তার ঐ দুঃসময় নিয়ে। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানালেন, ভাই আপনাকে একটা কথা বলি নাই। আমার ঐ ছয় মাসে, আমার বাবা-মা কোনদিন আমাকে জিজ্ঞাসাও করে নাই, আমি কেমন আছি, কি খাই, কেমনে চলে আমার দিন। আমি বলমাল, একদিনও না? উনি বললেন, না ভাই একদিনও না। এমনও সময় গেছে, পুরা সপ্তাহ শুধু পাউরুটি খেয়ে আমার দিন গেছে। খুব ভাত খেতে ইচ্ছা করতো, কিন্তু মনে হত ভাত খেতে গেলে যে টাকা চলে যাবে তা দিয়ে সপ্তাহ খানেকের জন্য এক প্যাকেট পাউরুটি হয়ে যাবে। দুই সপ্তাহ পরে পাঁচ সেন্ট করে জমায়ে জমায়ে দেখলাম ভাত খাবার মত একটু টাকা হয়েছে। ইন্ডিয়ান এক স্টলে গিয়ে তিনরকম সবজি দিয়ে ভাত কিনে খেয়েছিলাম। আমি লোকটাকে উত্তরে কিছু বলি নাই। আমার আসলে বলার কোন প্রয়োজন ছিল না।
প্রবাসে যেই ‘ছেলে’রা থাকে বা কাজ করে, তারা আসলে মানুষের পর্যায়ের কিছু না। আমাদের সভ্য জগতে ‘এগুলারে’ মানুষ গন্য করার কিছু নাই। এরা মাটির ফ্লোরে কাগজ বিছায়ে ভাত খাক, ছারপোকার উদর পূর্তি করায়ে রাতে কয়েক ঘন্টা শুয়ে থাক, অমানুষের মত শ্রম দিয়ে ডলার কামাক। ছোট ভাইকে স্মার্ট ফোন কিনে দিক, বোনের স্বামীকে সোনালী রঙের ঘড়ি কিনে দিক, অন্য ভাই এর পরীক্ষার ফিস দিয়ে দিক, কোন মাসে টাকা না দিতে পারলে মায়ের মুখের ঝামটা শুনুক, টাকা দিতে দিতে নিঃশেষ হয়ে শূন্য হাতে দেশে ফিরে আসুক। দেশে আসার পরে, দেখুক তার ভাই এর কি সুন্দর দালান তৈরী হয়েছে। বোনের রান্নাঘরটা পাকা হয়েছে। বোন জামাইয়ের সুন্দর একটা দোকান হয়েছে। ছোট ভাই স্মার্টফোনে ‘গার্ল ফ্রেন্ড’ এর সাথে ‘মামা’, ‘মাইরালা’ বলে চ্যাটিং করছে। আর এই এটিএম ‘ম্যাশিন’ টা অকেজো হয়ে ঘরে বসে বৌকে অসিয়ত করে বলছে, আমি মরে গেলে আমাকে ‘আব্বা-মা’র পাশে কবর দিও।