একটা ছেলের জীবনের অনেক ‘বড়’ একটা ‘ব্যাপার’ হচ্ছে তার আয়-উপার্জন। ছেলেটার মান সন্মান, ভালোবাসা, চাওয়া পাওয়া সব কিছু নির্ধারণ হয় এই টাকার অঙ্কের উপরে। এখানে কোন সাহিত্যিকের সাহিত্য কাজ করে না। এখানে থাকে শুধু একরাশ নির্মন বাস্তবতা। সমাজে একটা মানুষ সন্মান পাবে কি না পাবে সেটাও ঠিক হবে এই টাকা উপার্জনের উপরে। যে বেশী টাকা উপার্জন করে সে অবলীলায় কম পয়সাওয়ালাকে ‘তুমি’ বা ‘তুই’ তে নামিয়ে ফেলতে পারে। কোন সমস্যা নেই। এটা পয়সাওয়ালার ন্যায্য অধিকার।
যে ছেলের টাকা নেই, বা এখনও ভালো মানের কোন কাজ পাচ্ছে না, সোজা বাংলায় বেকার, তাকে ইচ্ছামত ডাকা যায়। তাকে খুব ভালো ভালো খেতাব দেয়া যায়। মজার কথা হচ্ছে, যেহেতু সে সবসময় মাথা নীচু করে থাকতে বাধ্য, তাকে ইচ্ছামত কথা শুনিয়ে দেয়া যায়, গালি দেয়া যায়। যার টাকা নেই, উপার্জন নেই, তার প্রতিবাদের কোন ভাষাও নেই। তার পুরুষত্ব নেই, তার কোন শব্দও নেই। সে শুধু বাস করবে এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ্যের জগতে। যে কোন কথায় তার সাথে খারাপ ব্যবহার করা যেতে পারে, তাকে যা খুশি তাই উপাধি দেয়া যেতে পারে। ‘অচল মূদ্রা’, ‘ঘোলের চুঙ্গা’, সিন্দাবাদের ভুত’ এগুলা খুব সাধারণ মানের উপাধি বলেই মনে হয়। মুখের সাধ মেটানো যায় এসব বলে। কারো যদি এতে তৃপ্তি না আসে, তাহলে তাকে মানুষের মধ্যেও এসব শুনিয়ে দেয়া যায়, তার দিকে তেড়ে মারতে আসা যায়, এসব খুব সাধারণ ব্যাপার। উপার্জনহীন একটা ছেলেকে ভাতের খোঁটা দেয়া যায়, তার স্ত্রীকে যথেচ্ছা কথা শুনিয়ে দেয়া যায়, তার পিঠপিছে ইচ্ছামত কথা শুনিয়ে দেয়া যায়। এসব তার প্রাপ্য। যার যার প্রাপ্য সেটা তাকে বুঝিয়ে দিতে আমাদের চারপাশের মানুষ গুলা কখনও কার্পণ্য করে না। দরকার কি? এতো রাখ ঢাকের দরকার কি? কিছু কথা শুনিয়ে দিলে কি আসে যায়?
যাদের উপার্জন ভালো, আমাদের সমাজে তাদের উপাধি হয় ‘সাহেব’। ওমুক ‘সাহেব’ এটা করেছে, তমুক সাহেব ওটা কিনেছেন। আজ এটা করছেন তো কাল ওটা করছেন। তাদের নাম নিতে গেলে ভক্তিতে গদগদ হয়ে তাদের নাম নিতে হয়। চোখ বিনয়ে অবনত হয়ে আসে, আসতেই হবে, হয়াই উচিত কারণ তাদের যে অনেক টাকা! তারাই প্রভু, তারাই দ্বিতীয় ইশ্বর! তাদের অর্থ বৈধ না অবৈধ সেটা কোন ব্যাপার না। তিনিও ‘সাহেব’, এই ব্যাপারটাই মুখ্য। ক’বছর আগে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এমন একজন ‘সাহেব’ এর দর্শন লাভের। উৎকট দর্শন, কিম্ভুট চেহারার সেই ‘সাহেব’ আমাকে তার জীবনের ‘দর্শন’ শোনালেন। দীর্ঘক্ষণ ধরে আমি তার ব্যক্তিগত জীবন, স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও বহুগামিতার উপাখ্যান, কিভাবে স্ত্রীকে সে টাকা দিয়ে খুশি রাখে, ড্রিঙ্কস, পার্টি করে কিভাবে সে ফূর্তি করে, শুনলাম। আমি আমার খুব কাছের কিছু আত্মীয়কে দেখেছি, ঐ ভদ্রলোকে তাদের কাছে প্রায় একজন ইশ্বরের কাছাকাছি। ভীষণ ভক্তি ভরে তার নাম নেয়। তার খোঁজ খবর নেয়। কথা বলার সময় সে একা আছে না, পাশে কোন মেয়ে শুয়ে আছে, ভক্তিভরে তার কাছে জানতে চায়।
আমাদের শহরে এখনও, যাদের নিজস্ব গাড়ী আছে, তারা বড়লোক শ্রেণীতে প্রোমশন পেয়ে যায়। গাড়িতে ওঠার আগে তারা সরু চোখে আসপাশ দেখে নেয়। তারা তাকায় সরু চোখে, আমি তাদের দিকে তাকাই ভরা চোখে, পুরো চোখ খুলে। আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে, এই মানুষগুলার মত হতে হলে আমার কি কি করা দরকার? এরা গাড়িতে ওঠার পরে একটা বিশেষ দৃষ্টি নিয়ে সামনে তাকায়! আমার ভীষণ আনন্দ হয় তাদের ঐ চাহনি দেখতে। খুব ভালো লাগে। আমি তৃষিত চোখে তাদের ঐ দৃষ্টিতে ধ্রুবতারা খুঁজি। হাতে ছাতা নিয়ে বৃষ্টির মধ্যের হেঁটে যাই বাসস্টপের দিকে। ঠান্ডা বাতাসের ঝাপ্টা গায়ে এসে লাগে, আর বৃষ্টির গন্ধ ভুলিয়ে দেয় আমার শ্বাসকষ্ট।