মা! তোমার কি মনে আছে-
একদিন তোমার ভাত রান্না করা দেখে বলেছিলাম,
“এত্ত বড় হাড়ি! এতগুলো ভাত কে খাবে?”
তুমি বলেছিলে, “কেন রে? বাড়িভর্তি কতো মানুষ!
কাছারি ঘরে বসা মজুরগুলো, দীঘির পাড়ের মনা মিয়া-
এরা সবাই যে খাবে”।
তোমার উত্তর শুনে-
আমি ঘুড়ি নাটাই নিয়ে খেলতে চলে গিয়েছিলাম।
গাঁয়ে কারো মৃত্যুর খবর পেলেই,
তুমি সেই বাড়ীতে কত খাবার পাঠাতে!
আচ্ছা মা! লাল পাড়ের সেই শাড়ীটা কি এখনও পর?
নাকি মেলায় পরে যাবে বলে আলমারীতেই তুলে রাখো?
তোমার প্রিয় লাল গাভী লালী কি এখনও দুধ দেয়?
সেবার আমাকে দেখে শিং উচিয়ে যেভাবে তেড়ে এল!-
উফ! মনে হলে এখনও পিলে চমকে যায়।
লালী যে তোমাকে ছাড়া আর কারো কথা শুনতই না।
রানুর পোষা বেড়ালটা কি তোমার এঁটোকাঁটা খেতে ঘুরঘুর করে?
আর ঐযে উঠানে শুয়ে থাকা ভুলুটা?
তুমি যখন ডালের বড়ি শুকাতে দিতে
ভুলু তখন পাহারা দিত।
সেবার উত্তর পাড়ার খুড়োমশাইকে দেখে, সে কি চিৎকার!
মেঝদাদার ছেলে টুনু কত বড় হয়েছে মা?
স্কুলে যাবে না বলে তোমার আঁচলের নীচে লুকিয়ে থাকতো!
অনেক বড় হয়ে গেছে না ওরা?
ওদের মনে হয় নিজেদেরই সংসার হয়েছে এখন-
কত ব্যস্ত ওরা, গ্রামে আসার কি সময় হয় ওদের?
তোমার উঠোন লেপে দিত যে বুলামাসি?
বেঁচে আছে?
পুজোর সময় কতো নাড়ু সন্দেশ খাওয়ায়াতো আমাকে!
সবার কথাই মনে পড়ে মা
মনে হয় যেন এই সেদিনের কথা।
অথচ শীতের ঝরা পাতার মত দিনগুলো ঝরলো একে একে
সবাই যে যার মত-
শুধু তুমিই আঁকড়ে রইলে ভিটেমাটি
স্বামীর স্মৃতি সাথে নিয়ে।
পাটি সাপ্টা, রস চিতই, পাকান পিঠার স্বাদ আর মনে পড়েনা
দোকানের কেনা পিঠায় কি মায়ের আদর থাকে?
তোমার মত করে তো ওরা বলে না, “নে আর একটা খা-
তোর না পিঠে পছন্দ!”
বড়দা’র সাথে আর কথা হল না ...
মানুষটা চলে গেল
বড়দি সেই যে বিদেশ চলে গেল; আর এলো না।
তোমার সেই সিন্দুকটা কই মা?
প্রতিবছর নতুন নতুন কাঁথা সেলাতে সবাইকে দেবে বলে?
এখনও কি আগের মত কাঁথা সেলাও?
দরকার হয় না মনে হয়- তাই না?
শীতে যখন কাঁথা গায় না দিয়েই ঘুমিয়ে যেতাম-
তুমি ঠিকই গাঁয়ে কাঁথা দিয়ে যেতে
কখনও ভুল হয়নি তোমার।
বিকেলে দাওয়ায় বসে ঠোত রাঙিয়ে পান খেতে খেতে চুল শুকোতে
মনে আছে তোমার সেসব? আমি যে কিছুই ভুলিনি-
সবকিছুতেই তোমার ছোঁয়া লেগে আছে
সবকিছুই আর ধূসর হয়ে গেছে ধুলোর প্রলেপে
স্মৃতির খাতার পাতাগুলো উলটে যাচ্ছে একে একে
আর তোমার সেই বড় ভাতের হাড়িটা-
ছোট হতে হতে কখন যেন শূন্য হয়ে গেছে।