এক//
আবিদ খুবই উত্তেজিত হয়ে আছে কখন মা আসবে আর নিজের মুখে সুসংবাদটা দেবে সেজন্য। ইচ্ছা করলে ফোনেও বলতে পারে কিন্তু সেক্ষেত্রে মায়ের প্রতিক্রিয়াটা আবিদ দেখতে পারবে না। ওর খুব ইচ্ছে করছে মায়ের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। বারবার ঘড়ি দেখছে, কখন মা আসবে। সময় যাচ্ছেই না। মনকে কিছুতেই অন্যদিকে ঘুরাতে পারছে না। মায়ের আসতে এখনও ঘন্টা তিনেক বাকী আছে। গল্পের বই পড়তেও ভাল লাগছেনা এখন। কিছু করার নেই, তারপরেও কি করবে ভেবে ভেবে আবার ক্যানভাস আর রংতুলি নিয়ে বসল। কম্পিউটারের স্ক্রীনে একটা ছবি নিয়ে হুবহু তেমন একটা ছবি আঁকার চেষ্টা করলো। নিজেও খুব ভাল আঁকে আবিদ। আনন্দের সূত্রপাত ছবি আঁকা দিয়েই।
ছবি আঁকতে আঁকতে একদম মগ্ন হয়ে গেল আবিদ। মায়ের আসার সময় কখন পেরিয়ে গেল মনেই নেই। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল। কলিং বেলের শব্দে সম্বিত ফিরে পেল আবিদ। দরজা খুলে মা কে দেখলো। মায়ের মুখ অনেক চিন্তাগ্রস্ত দেখে কি বলবে খুঁজে পেল না। লায়লাই প্রথমে কথা বললেন। ‘কি রে? ভাত খেয়েছিলি আবিদ?’
‘না মা। আমার মনেও নেই খেতে। তুমি দেরী করলে কেন?’
‘আমার এক কলিগ অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। তাকে দেখতে গিয়েছিলাম’। দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরে গেলেন লায়লা। পেছনে পেছনে আবিদ ও গেল মায়ের ঘরে।
‘কিছু খাবা না মা? ফ্রেশ হয়ে নাও। একসাথে খাই। একটা ভাল খবর আছে’।
‘কি ভাল খবর?’ লায়লার মুখে এবার একটু হাসি দেখা গেল।
‘এখন না মা। আগে খেতে বস। তখন বলব’।
‘ঠিক আছে। শরীফা কে বল খাবার দিতে। আমি আসছি’।
খাবার টেবিলের পাশে স্ট্যান্ড এ সদ্য আঁকা ছবিটা এনে রাখলো আবিদ। মায়ের জন্য খাবার বেড়ে অপেক্ষা করতে লাগল। লায়লা তার চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে টেবিলের পাশে এসে যখন বসতে যাবে তখন তার চোখ পড়লো ছেলের আঁকা ছবিটার দিকে। কিছুক্ষণের জন্য লায়লার মনে হল গলার কাছে কি যেন আঁটকে গেছে। হাঁসফাঁস লাগতে থাকে। আবিদ জিজ্ঞাসা করে, কেমন হয়েছে মা?
‘এই ছবি কে এঁকেছে আবিদ?’ তীক্ষ্ম চোখে ছবির দিক থেকেই নজর না সরিয়ে জানতে চান লায়লা।
‘কে আর আঁকবে? আমি এঁকেছি। আবিদ দ্য ভিঞ্চি’। বলেই হাসি হাসি মুখ করে মায়ের প্রতিক্রিয়া জানতে চায়, ‘কেমন হয়েছে?’
‘তুই কিভাবে এই ছবি পেলি? নিজে থেকে এঁকেছিস?’ এখনও লায়লা তাকিয়ে আছে ছেলের আঁকা ছবির দিকেই।
‘না মা। আইডিয়া আমার না। ওয়াটার কালার পেইন্টিং একটা প্রতিযোগিতার কথা বলেছিলাম না? এই ছবিটা ওখানে প্রথম হয়েছে’। আবিদ ছবির পাশে এসে দাঁড়ায় মাকে ভালো করে বোঝানোর জন্য।
‘বলেছিলি নাকি’? লায়লা অন্যমনস্ক ভাবে জিজ্ঞাসা করে।
‘তুমি ভুলে গেলে কি করে? আমিও তো ছবি দিয়েছিলাম। তোমার মনে নেই?’
‘ও হ্যাঁ! মনে পড়েছে’।
‘তুই কোন প্লেস পাস নি? তুই তো অনেক ভাল আঁকিস’। নিজের চেয়ারে বসে পড়ে লায়লা। একটু আগের ক্ষুধাবোধ এখন আর কাজ করছে না। মাথার দু’পাশে দপদপ করছে। মনে হচ্ছে এখনি শুয়ে পড়তে পারলে ভাল লাগতো। সারাদিন অনেক ধকল গেছে। ব্যাংকে কাজের অনেক চাপ এখন।
‘সেই কথাই তো তোমাকে বলার জন্য ছটফট করছিলাম। আমার ছবিটা প্রতিযোগিতায় পঞ্চম হয়েছে। ওরা আমাকে থাইল্যান্ডে যে ফাইন আর্টস এক্সিবিসন হবে তা দেখার জন্য প্লেনের টিকেট দিবে পুরস্কার হিসাবে। মা আমার যে কি খুশি লাগছে। তুমি খুশি হও নি?’
‘উম, হ্যাঁ অনেক খুশি হয়েছি। কবে হবে তোদের এক্সিবিসন? থাইল্যান্ডের ভিসার ব্যাপার আছে তো’। থালায় তুলে নেয়া ভাতগুলো ডাল দিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে জানতে চায় লায়লা। মুখে তোলেনি এখনও এক গ্রাসও।
‘দেরী আছে। এখনও তিন মাস সময় হাতে। এর মধ্যে আমার পরীক্ষাও শেষ হয়ে যাবে। আমার সাথে তোমাকেও যেতে হবে’।
‘আমি যেতে পারবো কিনা বলতে পারছিনা। ছুটি পাবো কিনা সেটাও চিন্তার বিষয়। তুই বললি এই ছবিটা প্রথম হয়েছে যেটা দেখে তুই এঁকেছিস? শিল্পী কে?’ ছেলের মুখের দিকে সরাসরি তাকালেন লায়লা। যদিও উত্তরটা তার জানাই আছে।
‘আরমান আহমেদ’। ছেলের মুখে নামটা শুনে হাতে নেয়া গ্রাসটা আবার প্লেটে তুলে রাখলেন লায়লা। প্লেট ঠেলে সরিয়ে অন্য একটা প্লেট দিয়ে ঢেকে দিলেন।
‘মা খাবে না?’
‘না রে। তুই খা। আমার শরীর ভালো লাগছে না। আমি একটু রেস্ট নিয়ে পরে খাব’।
‘বেশী খারাপ লাগছে মা? ডাক্তারের কাছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিব’?
‘আরে নাহ। চিন্তা করিস না। একটু রেস্ট নিয়েই আমি খেয়ে নিব’। বলেই নিজের ঘরের ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। ধপ করে বসে পড়লেন খাটের উপরে। নিজের অজান্তেই অনাহুত অতীত আবার তার সামনে চলে এলো। সে স্মৃতি কে মনের চিতায় দাহ করা হয়েছিল ভেবেছিল লায়লা, আজ সেই স্মৃতিই মনে হয় পুনর্জন্ম নিয়ে তাকে আঘাত করলো।
দুই//
পঁচিশ বছর খুব কম সময় নয়। আর কোন কিছু ভুলে যাবার জন্য মনে হয় খুব বেশীও নয়। লায়লা তখন চারুকলায় দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিল। শেষ বর্ষের মেধাবী ছাত্র আরমানের প্রেমে পড়ে যায় লায়লা। আরমানের কথা, হাসিঠাট্টা সবকিছুই খুব ভাল লাগতো লায়লার। ক্যাম্পাসে একসাথে অনেক সময় কাটিয়েছে তারা। লায়লাকে নানাভাবে সহযোগিতা করতো আরমান। লায়লা আরমানকে ভালোবেসে ফেলে। মুখ ফুটে আরমানকেও বলেছিল সেকথা। কিন্তু আরমানের মনোভাব ঠিকমত বুঝতে পারেনি তখনও।
লায়লা যখন তৃতীয় বর্ষে তখন ওর বিয়ের কথা প্রায় পাকাপাকি হয়ে যায়। ছেলে ব্যবসায়ী। বনেদী ঘরের ছেলে। এর আগের অনেক বিয়ের প্রস্তাব লায়লা নানাভাবে উপেক্ষা করে। কিন্তু এবারের প্রস্তাব এমন জোরালো ভাবে এসেছিল যে লায়লা নাকচ করার কোন উপায় পাচ্ছিলো না। হতাশায় যখন চোখে অন্ধকার দেখছিল, তখন লায়লা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল মনে মনে। আরমান যদি চায়, তাহলে লায়লা বাড়ী ছেড়ে আসতেও রাজী আছে।
একদিন দুপুর বেলা লায়লা আরমানের বাসায় হাজির হয়। নিজের সব কথা বলতে গিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো লায়লা। আরমানকে কতখানি ভালবাসে সে কথা অকপটে আবার বলল। সবকথা শুনে আরমান কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। মুখ থমথমে। এরপর মাথা নীচু করে বললো, আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না লায়লা। আমাকে ক্ষমা কর’।
‘কেন? আমি কি তোমার যোগ্য নই’? বলেই ডুকরে কেঁদে ফেলে লায়লা।
‘তা তুমি কেন। আমিই তোমার যোগ্য নই’। আরমান মাথা নীচু করেই উত্তর দেয়। লায়লার চোখের দিকে তাকাতেও পারছিল না সে।
‘তুমি কি কাউকে পছন্দ কর আরমান?’
‘না’।
‘তবে?’
‘আমি তোমাকে সব কথা বলতে পারবো না লায়লা। তুমি আমাকে হয়ত ঘৃণা করবে। তোমার ঘৃণা নিয়ে আমি সারাজীবন বাঁচতে পারবো না’। আরমান অনুনয় করে বলে।
‘প্লীজ আমাকে বল। কেন তুমি আমাকে বিয়ে করবে না?’ বলতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ফেলে লায়লা। ওকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা খুঁজে পায় না আরমান। মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারে না। উঠে গিয়ে একটা চিরকুটে দু’টা কথা লিখে লায়লার হাতে দেয়। লায়লা চিরকুটটার দিকে তাকিয়ে কি বলবে বুঝে পায় না। কাঁদতেও ভুলে গেল। কিছুক্ষণ পরে নিজেকে সামলে নেয়। দেখে আরমান তখনো তাকিয়ে আছে তার দিকে। দুই চোখ দিয়ে তারও পানি গড়িয়ে পড়ছে। লায়লা চোখ মুছে নিজেকে শান্ত করে নেয়। আরমান কিছু বুঝে উঠার আগেই সে আরমানকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আমাকে ক্ষমা করে দিও’। এরপর আরমানের বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। আর কখনও আরমানের সাথে ওর দেখা হয়নি।
তিন//
রাতে আবার মা ছেলে একসাথে বসেছে লায়লার ঘরে। ল্যাপটপ খুলে মাকে প্রথম হওয়া আসল ছবিটা দেখালো আবিদ। লায়লা যে চারুকলার পড়েছে এটা ছেলেকে জানতে দেয়নি কখনও। বিয়ের পরে লায়লা চারুকলায় পড়া ছেড়ে দেয়। স্বামীর উৎসাহে আবার নতুন করে অনার্সে ভর্তি হয়। পাশ করার পরে ব্যাংকে চাকরী নেয়। আবিদের যখন ছয় বছর বস তখন লায়লার স্বামী হঠাৎ অ্যাক্সিডেন্ট করে মারা যায়। লায়লা কঠোর পরিশ্রম করে ছেলেকে মানুষ করে তুলেছেন। ছবি আঁকার ব্যাপারে ছেলের আগ্রহ দেখে লায়লা কখনও তাকে নিরাশ করেনি। লেখাপড়ার পাশাপাশি ছেলেকে আর্টের স্কুলেও ভর্তি করেছিল।
‘মা, এই শিল্পীকে জিজ্ঞাসা করেছে উনার আঁকা এই ছবির মর্মার্থ কি? উনি কাউকে এর উত্তর দেয় নি। বলেছে, আমার আঁকা আমি এঁকেছি। মর্মার্থ দর্শক তাঁর নিজের মত করে বুঝে নিবেন। কেমন আজব না মা? কি অদ্ভুত কন্সেপ্ট। একটা মেয়ে নীল শাড়ী পরে সাগরের পানি উপরে দাঁড়িয়ে আছে আর একটা লোক পাড়ে মাথা নীচু করে বসে আছে। পানির নীচ থেকে আবার একটা ছোট বাচ্চা মেয়েটির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে কিন্তু তাকে ধরতে পারছে না। আমি নিজেও এটা নিয়ে অনেক ভাবলাম। আমি এর আগামাথা কিছুই বুঝলাম না। তোমার কি মনে হয় মা?’
‘আমি এসবের কি বুঝি। তুই ছবি আঁকিস। তোর যা মনে হয় তুই ভেবে নে না’। মৃদু হাসেন লায়লা।
‘সবই ঠিক আছে মা। পানির নীচে এই ছোট বাচ্চাটার কোন মানে আমি অনেক চিন্তা করেও দাঁড় করাতে পারলাম না’। আবিদ কিছুটা হতাশার সুরে বলে।
‘কি জানি। বাচ্চাটা হয়তো তুই’। লায়লা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে নীচু স্বরে বলে।
‘কি বললে মা? বুঝিনি।’ আবিদ পালটা প্রশ্ন করে।
‘কই কিছু না তো’।