সারাদিন চাদর বিক্রি করে কত টাকা উপার্জন হল, মোস্তফা তাই গুনে দেখছিল। লুঙ্গির গিটের সাথে কোমরে গুজে রাখা মোবাইলটা বেজে উঠলো। আজ সারাদিন তেমন কোন বেচা-বিক্রি হয় নাই। মন মেজাজ তেমন ভাল নেই মোস্তফার। এদিকে রাত হয়ে গেছে অনেক। প্রায় ১১ টার মত বাজে। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো তারই স্ত্রী হালিমা ফোনটা দিয়েছে। এতরাতে তো সাধারণত ফোন দেয় না। মনের মধ্যে কু-ডাক দিল মোস্তফার। ফোন কানে দিয়েই স্ত্রীর কান্নার শব্দ শুনতে পেল। কান্নার শব্দের সাথে যা শুনলো তা হল, মোস্তফার মেয়েটার শরীর খুব খারাপ। প্রচন্ড জ্বর গায়ে। আর বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। হালিমা তাকে রাতেই বাড়ী চলে আসতে বলতেছে যেভাবে হোক।
হতভম্ব মোস্তফা কি করবে সাত-পাঁচ ভেবে কূল পায় না। এত রাত হয়ে গেল, এখন কিভাবে রওনা দিবে? এদিকে হাতে টাকা পয়সাও নেই বেশী। কিন্তু এসব ভেবে আর সময় নষ্ট করল না সে। হাতের কাছে রাখা পোটলাটার মধ্যে দু’একটা কাপড় আর সাথে টাকা যা ছিল নিয়ে রওনা দিল। রাস্তায় কোন ভ্যান, রিক্সা কিছুই দেখা যাচ্ছে না। উপায় না দেখে জোর পায়ে হাঁটা দিল সে। বাস স্টেশন ওর বাসা থেকেও প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে। হাঁটা কোন সমস্যা না ওর জন্য। কিন্তু আজ কেন যেন পা চলতে চাইছে না। মেয়েটার মুখ বারবার মনে পড়ছে। চোখে পানি চলে আসছে একটু পরপরই। মোস্তফা একমনে হেটে চলে মেঠো রাস্তা দিয়ে। আকাশে চাঁদের দেখা নেই। আজ কি অমাবশ্যা নাকি? শুধু কিছু তারা দেখা যাচ্ছে। হাতের টর্চলাইটটা বেশী জ্বালছে না; যদি ব্যাটারী শেষ হয়ে যায়, তাহলে অনেক বিপদে পড়ে যাবে।
রাস্তার পাশের বড় বড় গাছগুলার দিকে তাকালে পাতা দেখা যায় না। মনে হয় বড়সড় কোন কালো দানব দাঁড়িয়ে আছে। গা ছমছম করতে থাকে মোস্তফার। মানুষ হিসেবে খুব একটা ভীতু নয় মোস্তফা। কিন্তু আজ ওর কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগলো। মনে মনে আল্লাহর নাম নিয়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল। রাতের বাস ওকে ধরতেই হবে যেভাবেই হোক। বড়দিঘীর পাড়েই এ এলাকার সবচেয়ে পুরানো গোরস্থান। মোস্তফার অনেক আগে থেকেই কিছুটা গোরস্থান ভীতি ছিল। নিতান্তই কারো দাফনের দরকার না হলে হলে সে গোরস্থানের আশেপাশেও যায় না। গোরস্থানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় মনের ভিতর শিরশিরে একটা ভয়ের অনুভূতি হল। টর্চ জ্বেলে দিল সে। দ্রুত হেঁটে পার হতে চাইলো। কিন্তু মনে হচ্ছিল যতই হাঁটছে, পথ যেন ততই বেড়ে যাচ্ছে। এবার প্রায় দৌড় দিল সে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে, কিন্তু ভয়ে পানি খাওয়ার কথাও ভুলে গেছে সে।
দৌড় দিয়ে যেই কিছুদূর গিয়েছে, পেছন থেকে একটা খসখস শব্দ শুনতে পেল স্পষ্ট। আর কে যেন ওর ঘাড় ছুঁয়ে দিল। ঝট করে পেছনে তাকিয়ে দেখলো কেউ নেই। গোরস্থানের কোনায় অবহেলায় বেড়ে ওঠা সুপারি গাছগুলোর কালো অবয়ব বাতাসে দুলছে। ভয়ে মোস্তফা ঘামতে শুরু করলো। পথে কাঠের একটা গুড়ি ছিল। খেয়াল করেনি, পায়ে বেঁধে পড়ে গেল মোস্তফা। হাঁটুর কাছে ছিলে গেলো কিছুটা। কোনমতে উঠে দাঁড়ালো। আবার হাঁটতে চেষ্টা করলো। কিন্তু এবার একটু খুড়িয়ে খুড়িয়ে। পথ বুঝি আর শেষ হয় না। আবার টের পেল পেছনে কে যেন আসছে। এবার মোস্তফার আর কোন সন্দেহ রইলো না যে, এটা কোন জ্বীন হবে। অমাবশ্যার রাতে নিশ্চয়ই কোন খারাপ জ্বীন ওর পিছু নিয়েছে। মনের দুঃখে চোখে পানি এসে গেল। আল্লাহর কাছে দোয়া করলো, আল্লাহ তুমি আমাকে এই বিপদ থেকে বাঁচাও।
এভাবে পথ চলতে চলতে কখন যে দিশেহারার মত মোস্তফা বাস স্ট্যান্ডে চলে এলো তা সে নিজেও বলতে পারে না। হারিকেন জ্বালিয়ে বসে আছে একজন কর্মচারী দেখা গেলো দূর থেকেই। বুকটা হাপরের মত ওঠানামা করছে। মোস্তফার। পিপাসায় বুকের ছাতি ফেঁটে যাচ্ছে। একটু বসতে পারলে হত। কিন্তু বসার সময় নাই। তড়িঘড়ি করে টিকেট কাউন্টারের কাছে এসে পৌঁছাতেই দেখে, ছেলেটা হারিকেন নিয়ে বের হয়ে এলো। দরজা লাগিয়ে দিচ্ছে। গলা দিয়ে কেমন যেন চি চি আওয়াজ বের হল মোস্তফার। নিজের কণ্ঠকে নিজেই চিনতে পারলো না। কোনমতে বলল, ও ভাই! আমারে একটা টিকেট দাও। কাউন্টারের ছেলেটা মোস্তফাকে চিনতে পারলো।
‘আরে মোস্তফা ভাই, তুমি এত রাইতে কি কর?’
‘ভাই আমারে জলদি একটা টিকেটা দাও। মাইয়াডার অনেক অসুখ। আমার বাড়ী যাইতে হইব’। কাতর স্বরে বলে মোস্তফা।
‘আইজ তো আর বাস নাই ভাই; কেমনে যাইবেন?’
‘বাস নাই ক্যান?’ রাইতের শেষ বাসটা কখন আইবো?
‘শেষ বাস চইলা গেছে একটু আগে। এখন রাইত কর হইছে দেখসেন না? বাড়ী চইলা যান ভাই। এও রাইতে আর কোন গাড়ি পাইবেন না। সকাল সাড়ে সাতটার আগে আর কোন বাস নাই’। বলে ছেলেটি চলে যায় তার গন্তব্যে।
মোস্তফা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। চোখে পানি চলে আসে। একটু আগের ভয়ভীতির কথা আর মাথায় থাকে না। কাপড়ে পুটলিটা মাটিতে রেখে বসে পড়ে। কি করবে ভেবে পায় না। রাস্তায় একটা মানুষ দেখা যায় না। মাঝে মাঝে এক ঝলক বাতাসের ঝাপটা গায়ে লাগে। মোস্তফা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে দুই হাতে মুখ ঢেকে। শুধু মেয়েটার মুখ মনে পড়ে। সাথে যে একটা মোবাইল ফোন আছে সেই কথাও ভুলে যায়। কাউকে ফোন দিতে ইচ্ছা করে না। ফোন দিলেই হালিমা জানতে চাইবে কখন আসবে? কি বলবে সে হালিমাকে?
কাঁদতে কাঁদতে কতটা সময় পার করে বলতে পারবে না মোস্তফা। মনের কষ্টে দুই হাত দিয়ে পাগলের মত মাটিতে চাপড় দিতে দিতে বলতে থাকে, আল্লাহ আমার মাইয়াডারে তুমি বাঁচাও আল্লাহ! এক সময় মোস্তফা ক্লান্ত হয়ে যায়। চোখ একটু লেগে আসে ক্লান্তিতে।
হঠাৎ চোখ খুলে সামনে তাকিয়ে দেখে সাদা আলখাল্লা পরা একজন বৃদ্ধ মোস্তফাকে ডাকছে। মুখটা ভালমত দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু মুখভরা সাদা চাপদাঁড়ি দেখা যাচ্ছে। লোকটার দাঁড়ির ভেতরে একটা জোনাকী পোকা আঁটকে গেছে। সেখান থেকে মৃদু মৃদু আলো আসছে। মোস্তফা হিতাহিত জ্ঞান ভুলে এক চিৎকার দিল ভয়ে। নিশ্চই সেই জ্বীনটা আবার ফেরত এসেছে। ভয়ে ঘামতে লাগলো মোস্তফা। বলতে লাগল, ‘আমারে মাফ কইরা দেন। আমি কিছু করি নাই। আমি বাড়িতে যামু’।
‘তুমি ভয় পাও কেন? তুমি এখানে বসে ছিলা তাই তোমাকে দেখতে আসলাম। আমি জ্বীন ভূত না রে বাবা। আমি মানুষ। বিশ্বাস না হইলে গা ছুয়ে দেখ। বৃদ্ধ লোকটি হাত বাড়িয়ে দেয়। মোস্তফার সাহস হয় না লোকটির হাত ছুঁয়ে দেখতে। অবর্ণনীয় আতঙ্কে সে কথা বলতেও ভুলে গেছে। রাতের মত আবার সেই ভয়াবহ পিপাসা পেয়ে গেল। কোনমতে জিজ্ঞাসা করলো, ‘আপনে কে’?
‘আমি পাশের ঐদিকে গ্রামে থাকতাম’। বলে বৃদ্ধটি হাত দিয়ে একদিকে ইশারা করে। লোকটির গা থেকে আতরের কড়া গন্ধ ভেসে আসছে। সুন্দর ফুলের গন্ধ কিন্তু মোস্তফা মনে করতে পারছে না ফুলের নাম।
‘আপনি এত রাইতে কি করেন?’
‘তুমি কই যাইবা বাবা’? লোকটি মোস্তফার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে।
মোস্তফা মেয়ের অসুখের কথা এবং বাড়িতে যাবার জন্য বাস না পেয়ে যে এখানে বসে ছিল তা জানায় বৃদ্ধকে।
‘তা এখন কি করবা? বাস তো নাই?’
‘জানি না কি করমু। বাস না আসা পর্যন্ত আমি এখানেই থাকুম। আপনের পরিচয় কি? এত রাইতে আপনি কি করেন রাস্তায়?’
‘কিছু না বাবা। রাস্তা দিয়া হাঁটি। আইজ না আইলে কি আর তোমার লগে দেখা হইতো। তুমি একটু আগে দুই হাত দিয়া এমনভাবে আমার পিঠে মারছো যে আমার পিঠে দাগ হইয়া গেসে। বলেই বৃদ্ধ পিঠের কাপড় সরিয়ে দেখায়’।
‘আমি আপনাকে কখন মারসি?’ মোস্তফার চোখ বড় বড় হয়ে যায়।
‘একটু আগে মাটিতে চাপড় দিতে দিতে কানতাসিলা। ঐ মাটির নীচেই আমি থাকি বাপ’।
বেহুঁশ হবার আগে মোস্তফা সত্যিই বৃদ্ধের পিঠে দুইটা হাতের ছাপ দেখতে পায়। এরপরের ঘটনা তার আর কিছু মনে নাই। হুঁশ যখন ফিরে তখন সে নিজেকে তারই বাড়ির উঠানে আবিস্কার করে। চাঁদের আলোয় সবকিছু মনে হচ্ছে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। ওর বাড়ির পাশের মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিন সাহেবের পরিচিত কন্ঠে আজানের শব্দ ভেসে আছে। কিভাবে সে নিজের বাড়িতে এলো কাউকে বলতে সাহস হয় না। জানে রাতের কথা বললে, লোকে ওকে পাগল ভাববে।