ডায়রী লেখার শখ সাব্বিরের অনেকদিন থেকেই। বাবার উৎসাহে সে ডায়রী লেখা শুরু করে। আজও সাব্বির লিখতে বসেছে বাবার দেয়া কলমটি দিয়ে। ডায়রীটা চোখের সামনে থেকেই বার বার ঝাপসা লাগতে থাকে। বারবার চোখে মুছে আবার সে লিখতে থাকে। হয়ত এটাই ওর শেষ লেখা। কাউকে সম্বোধন না করেই সে লিখে যায়-
“যে দুঃখ আমি এতদিন মনের ভেতর পুষে রেখেছি, তা আমার জন্য ক্রমে ক্রমে অসহ্য হয়ে উঠছে। আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিনা আমার অতীত। এভাবে চলতে থাকলে আমি মনে হয় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবো। আমি কারো গলগ্রহ হয়ে থাকতে চাই না। আমার মনের যে দুঃখ সেটা আমি কাউকে বলেও বোঝাতে পারছি না। আমি একটু শান্তি চাই। জানি বেঁচে থাকতে আমি সেটা পাব না। তাই আমি এই পথ বেছে নিলাম। আমি সকলের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী...”
এইটুকু লিখেই সাব্বির টেবিল থেকে উঠে পড়ে। টেবিলের ড্রয়ারে রাখা ঘুমের ওষুধের শিশি থেকে হাতের তালুতে বেশ কয়েকটি নিয়ে মুখে পুরে দিয়ে পানি দিয়ে গিলে নেয়। এরপর একটু হাসতে চেষ্টা করে। কিন্তু চোখের পানি ঠোটের উপরে এসে পড়ায় আর তা হাসি হয়ে ওঠে না। সাব্বির খাটের উপরে শুয়ে পড়ে।
রাতে পানি খেতে উঠে যুথির চোখ পড়ে ভাইয়ের ঘরের দিকে। দরজা খোলা, লাইট জ্বালানো দেখে উঁকি দিয়ে দেখে। ভাইয়া জেগে থাকলে দু’একটা বিষয় নিয়ে আলাপ করা যাবে। যুথি ভাইয়ের দরজায় নক করে, ভাইয়া আসবো? ঘর থেকে কোন সাড়া পায় না। দরজা খুলে ঘর ঢুকে দেখে ভাই শুয়ে আছে। মনের মধ্যে কেমন যেন একটু খটকা লাগলো যুথির। দুই তিনবার ভাই কে ধাক্কা দিল। কিন্তু কোন সাড়া পেল না। সাব্বিরের ঠোটের কোনা বেয়ে লালা গড়িয়ে পড়লো। এবার বুকের মধ্যে ধ্বক করে উঠলো ওর। মাত্র পানি খেয়ে এলেও আবার পিপাসা পেয়ে গেলো। টেবিলের উপরে ডায়রীটা খোলাই ছিল। সাব্বিরের লেখাটুকু এক নিঃশ্বাসে পড়ে যুথি যা বোঝার বুঝে গেও। টেবিলের উপরে খালি ওষুধের বোতলটা চোখে পড়লো তার। ভীষণ ভয়ে মুখ দিয়ে নিজের অজান্তেই চিৎকার দিল যুথি। বাবা সিঙ্গাপুরে গেছে ব্যবসার কাজে। মা শুধু একা বাসায়। যুথির চিৎকার শুনে ওর মা চলে এলো সাব্বিরের ঘরে। এই পরিস্থিতিতেও মহিলা বিচলিত না হয়ে, দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স আসতে বললেন ফোন করে। যুথিকে মানা করলেন, ওর বাবাকে এখনই কিছু না জানাতে। ছেলের পাশে বসে ছেলের নিঃশ্বাস খেয়াল করলেন। বুক ওঠানামা করছে আস্তে আস্তে। যুথি ভেবে পায় না, মায়ের চাইতে বেশী শক্ত মনের কোন মহিলা আর দেখেছে কিনা। মা কে যুথি সবসময়ই ভয় পায়।
রাত দুইটার দিকে অ্যাম্বুলেন্স আসলে বাসার দারোয়ানের সাহায্য নিয়ে সাব্বিরের ঘুমন্ত শরীরটা অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হল। যুথি আর ওর মা সাবিনা বেগম এক কাপড়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসলেন। যাবার আগে দারোয়ানকে বলে গেলেন, কাউকে জানাজানি না করতে। যুথি ভয়ে ভয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো, মা এর মুখ থমথম করছে। ভয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস হল না যুথির।
হসপিটালে নেয়ার সাথে সাথেই সাব্বিরকে ইমার্জেন্সীতে ভর্তি করে নেয়া হয়। ডিউটি ডাক্তার জানায় এখনই সাব্বিরকে ওটিতে নিয়ে স্টোমাক ওয়াশ করাতে হবে। সাবিনা বেগম ডাক্তারদের তাদের সব দরকারী পদক্ষেপ নিতে বলেন। যাবতীয় কাগজে সই করে নিজের সম্মতি দিয়ে দিলেন। সাব্বিরকে নিয়ে যাওয়া হল। সাবিনা মেয়েকে নিয়ে চেয়ারে বসে পড়লেন। মায়ের মুখ আগের মতই থমথমে। মায়ের অবস্থা দেখে, আর কিছু বলার সাহস হল না যুথির।
হসপিটাল থেকে তিনদিন পরে ছাড়া পেল সাব্বির। শরীর ভীষণ দুর্বল হয়ে গিয়েসে। কিছু জিজ্ঞাসা করলেও কথা বলে না। কেমন যেন ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে থাকে। সাবিনা নিয়ম করে ছেলেকে ওষুধ পথ্য খাওয়াতে লাগলেন। ছেলে কেন এমন কাজ করল এ ব্যাপারে সাবিনা নিজে থেকে কিছুই জিজ্ঞাসা করলেন না। ছেলের ইচ্ছা হলে নিজেই বলবে। বাসায় আনার পরদিন দুপুর বেলায় সাবিনা ছেলের ঘরে এলেন। ছেলে ঘুমিয়ে আছে মনে করে চলে যাচ্ছিলেন। সাব্বির ডাক দিল, ‘মা একটু বসবে’? সাবিনা ছেলের পাশে গিয়ে বসলেন।
‘আমাকে মাফ করে দাও মা। আমার অন্যায় হয়ে গেছে’।
‘এখন থাক এসব কথা সাব্বির। তুই ঘুমা’।
‘না মা। তুমি একটু বস। আমার ঘুম আসছে না’।
‘কিছু বলবি?’
‘মা, আমার পরিচয় কি? আমি আসলে কে মা?’
সাবিনা ছেলের দিকে তাকালেন। ‘তোর এই কথার মানে কি সাব্বির?’
‘ছোটবেলা থেকে অনেক মানুষের কানাঘুষা শুনেছি। তোমার, বাবার বা যুথি কারো সাথে আমার চেহারা মেলে না। আমি আসলে কে মা? প্লিজ আমাকে বল মা’।
‘চেহারা মিলতেই হবে এমন কোন কথা আছে?’ ঠান্ডা কন্ঠে প্রশ্ন করলেন সাবিনা।
‘মা, তোমার আর বাবার ব্লাড টেস্ট করারনোর সময় আমি ডি এন এ টেস্ট করেও দেখেছি মা। প্লিজ বল মা আমি কে?’
‘এতদূর তোর সন্দেহের মাত্রা চলে গিয়েছিল যে তোকে ডি এন এ টেস্ট করাতে হয়েছে? ঠিক আছে। হ্যাঁ আমরা তোর জন্মসূত্রে পিতামাতা না’। সাবিনার কণ্ঠ আগের মতই নিরুত্তাপ।
‘আমায় কোথা থেকে এনেছিলে মা?’ সাব্বিরের দুই গাল বেয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে।
‘তোর মা আমার এক নিকটাত্মীয় ছিল। মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিতা হাজারো মেয়ের একজন ছিল তোর মা। ।এখনকার ভাষায় বলতে গেলে, তোর মা ছিল একজন বীরাঙ্গনা। এখন আর সে হতভাগী বেঁচে নেই। তোর জন্মের দুই মাস পরে সে মারা যায়। আত্মহত্যা করেছিল না কি অন্য কোন কারণে মরেছিল সেটা আমাদের এখনও অজানা’। সাবিনা একটু থামলেন।
‘আমি কি তাহলে একজন নাম পরিচয়হীন জারজ সন্তান মা?’ দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে সাব্বির কেঁদে ফেলে।
‘তুই আজ তোর মা’কে যেমন অসন্মান করলি, তেমনি নিজেকে জারজ বলে আমাকে আর তোর বাবাকেও অসন্মান করলি’। কঠিন স্বরে কথাগুলা বললেন সাবিনা। ‘আমার ভাবতেও খারাপ লাগছে, আমাদের দেয়া কোন শিক্ষাই তোর মূল্যবোধ পাল্টাতে পারেনি। এবার সাবিনার চোখে ছলছল করে ওঠে।
‘মা, আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি তোমার মনে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। আমি আর এমন কথা বলব না। শুধু আমাকে আমার জন্মদাত্রী মায়ের পরিচয়টা বল মা’। সাব্বির কাতর স্বরে অনুরোধ করে।
‘বলব, তবে আজ নয়। যেদিন সত্যিকারের মানুষ হবি, নিজের জন্মদাত্রী মায়ের যথাযত সন্মান করতে শিখবি; সেদিন বেঁচে থাকলে বলব। তুই এখন বিশ্রাম কর। তোর বিশ্রাম দরকার’। ছেলেকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সাবিনা ঘর থেকে বের হয়ে আসেন।