তন্দ্রা মাথা নিচু করে খাবার নাড়াচাড়া করছে কিন্তু অনেক্ষণ ধরেই কিছু মুখে তুলছে না। ওর মন খুব খারাপ। ওর বাবা অনেক্ষণ ধরে মেয়েকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখছেন। কিছু বলছেন না। মেয়ের মন খারাপের কারণটা তার জানাই আছে।
-বাবা?
-কি মা? তোর কি মন খারাপ?
-তা তো খারাপই। এখন আমার আর যেতে ইচ্ছা করছে না বাবা।
-সেকি? মাত্র তো ক’টা বছর। ডিগ্রি নিয়েই না হয় আবার চলে আসিস।
-মা’কে তো তুমি চেনই বাবা। আমি জানি না পরে কি হবে।
-তুই এখন বড় হয়েছিস। তুই দেশে থাকতে চাইলে তোর মা মানা করবে কেন?
-জানি না কেন বাবা। তোমাকে একটা প্রশ্ন করেও আমি কখনই ঠিকমত উত্তর পাই নি বাবা। জানি এখনও হয়ত বলবে না। তবুও বলি। তোমরা আলাদা হয়ে গিয়েছিল কেন?
-আবার সেই কথা তন্দ্রা? তুই এখন অনেক বড় হয়েছিস মা। দু’জন মানুষ যদি মনে করে যে তাদের মনের মিল কোথায় যেন নষ্ট হয়ে গেছে; তখন কি আর তাদের একসাথে থাকা চলে? চললেও সেটাকে সংসার বলা যায় না রে। আমি হয়ত তোর মায়ের যোগ্য ছিলাম না। তাই আর একসাথে থাকা হল না। তুই তো তেমন কিছুই খেলি না। প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য তাড়াতাড়ি বললেন তন্দ্রার বাবা।
-ওখানে গিয়ে কার সাথে এভাবে খেতে বসব বাবা? তন্দ্রার চোখ ছলছল করে উঠল।
-ওখানে তোর অনেক নতুন বন্ধু হয়ে যাবে। রিসার্চ নিয়ে এত ব্যস্ত থাকতে হবে যে আমাদের কথা মনেই থাকবে না। তোর ফ্লাইট যেন কবে? ও ভালো কথা, তোর থিসিসের সুপারভাইজরের কি যেন নাম বলেছিলি?
- ২৩ তারিখে সকাল সাড়ে এগারোটায় ফ্লাইট। ২৫ তারিখে ওরিয়েন্টেশন। আর সুপারভাইজর হল প্রফেসর হারুন বিন হাজি আজমল। তন্দ্রা টিস্যু দিয়ে চোখ মুছতে লাগলো।
-অল দ্য বেস্ট মা! তোর রিসার্সের খুঁটিনাটি আমাকে জানাস। আমি তোকে হেল্প করতে পারবো।
-সেটা কি আর তোমাকে বলতে হবে বাবা? আমি তোমাকে এত জ্বালাবো যে তুমি তোমার নিজের কাজ সব ভুলে যাবা। তন্দ্রার ঠোঁটে এবার একটু হাসি দেখা দেয়।
-তাহলে ডিগ্রিটার ভাগ আমাকেও দিস না হয়। তন্দ্রার বাবাও মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো।
------
গাড়ি থেকে নেমেই তন্দ্রা একছুটে বাবার কাছে গিয়ে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। অনেক সময় লাগলো মেয়েকে বুঝিয়ে শান্ত করতে। তন্দ্রার বাবা আড়চোখে তন্দ্রার মাকে দেখলেন। শিরিন এখনও আগের মতই আছে। মুখে কোন ভাবান্তর আছে বলে মনে হল না। থাকলেও তা সানগ্লাসের আড়ালেই রয়ে গেছে। তন্দ্রা ততক্ষণে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। বাবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে এয়ারপোর্টের স্লাইডিং ডোর ঠেলে ভেতরে চলে গেল। শিরিন যাবার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তন্দ্রার বাবাকে দেখলো। একটু তাচ্ছিল্যের হাসি দিল কি? ঠিক বোঝা গেল না।
------
সকাল ৮ টা থেকেই তন্দ্রা হাতে সিরিয়াল নিয়ে বসে আছে। আজকেই সুপারভাইজরের সাথে দেখা করতে হবে। এরপর ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে যেতে হাবে। প্রায় ৯ টার দিকে তন্দ্রার ডাক পড়লো। ডেস্কে গিয়ে তন্দ্রা নিজের সিরিয়াল বলতেই, অফিসার জানালো- তন্দ্রার সুপারভাইজর চেঞ্জ করে দেয়া হয়েছে। মনে মনে ভীষণ হতাশ বোধ করলো তন্দ্রা। বারবার বাবার কথা মনে পড়তে লাগলো। তন্দ্রা জানতে পারলো, প্রফেসর হারুন হল তন্দ্রার কো-সুপারভাইজর। নতুন সুপারভাইজরের নাম প্রফেসর এ.আর. খান। নাম শুনে বোঝা গেল না বাংলাদেশী না ইন্ডিয়ান। তন্দ্রার মনে হল পায়ের নীচ থেকে বুঝি মাটি সরে গেল। নতুন সুপারভাইজর কেমন কি হবে না হবে সেটা নিয়ে সাত-পাঁচ ভাবতে লাগলো। একটু আগেও খিদা লাগলেও এখন আর কিছু মনে হচ্ছে না। ডেস্কের অফিসার তন্দ্রাকে জানালো রুম-৩১৬ তে যেতে। প্রফেসর খান এর রুম। এখুনি উনার সাথে তন্দ্রাকে আগে দেখা করতে যেতে হবে।
দরজার উপরে প্রিন্ট করে বড় করে লেখা, প্রফেসর এ আর খান। তন্দ্রা মৃদুভাবে দরজায় নক করলো । ভেতর থেকে গুরুগম্ভীর শব্দ ভেসে আসলো, কাম ইন! তন্দ্রার মনে হল এখনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। লম্বা করে একটা শ্বাস নিয়ে দরজা খুলে ফেলল তন্দ্রা। আস্তে করে বলল, গুড মর্নিং স্যার।
-গুড মর্নিং! প্রফেসর তখন তার চেয়ারে তন্দ্রার দিকে পিঠ দিয়ে বসা। আবার বললেন, হ্যাভ আ সিট।
তন্দ্রা মাথা নীচু করে বসে রইলো। মনে মনে ভাবছে, কতক্ষণে এই প্রফেসরের রুম থেকে বের হবে।
-কেমন আছিস মা?
প্রচন্ড বিস্ময় নিয়ে তন্দ্রা তাকিয়ে দেখে চেয়ারে বাবা বসে আছে।
কথা বলতেও যেন ভুলে গেল তন্দ্রা। কয়েক সেকেন্ড পরে বলল, বাবা তুমি! নিজের গলার আওয়াজ নিজেই চিনতে পারলো না,
-কেন রে? আমি কি থাকতে পারি না? তোমার মায়ের মত তুইও আমাকে চিনতে ভুল করলি?
-বাবা তুমিই কি তাহলে আমার সুপারভাইজর? খুশিতে তন্দ্রার নাচতে ইচ্ছে করছে।
-ইয়েস ইয়াং লেডি। প্রফেসর হারুন আমার ঘনিষ্ট বন্ধু। আর আমি এই ভার্সিটিতে জয়েন করেছি। ইনফ্যাকট তোমার থিসিস টপিক আমারই ঠিক করে দেয়া।
-আমাকে বল নি কেন বাবা?
-তোকে সারপ্রাইজ দেব বলে জানাইনি। তোর নতুন বাসা কি পছন্দ হয়েছে মা?
-হা বাবা। খুব সুন্দর। তুমি জানলে কিভাবে?
-একজন সুপারভাইজরের জন্য তার স্টুডেন্ট এর অ্যাড্রেস বের করা কি খুব মুশকিলের কাজ? মেয়ের দিকে তাকিয়ে বাবা মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন!