//এক//
‘তোমার অনেক কষ্ট হইতাসে, তোমারে হাসপাতালে নিতে হইব। মামারে খবর দেই? মামার তো অনেক আছে?’ কাঁদতে কাঁদতে শয্যাশায়ী মাকে কথা কয়টি বলল তমাল।
‘না বাবা। তোর আল্লা’র দোহাই লাগে। ভাইজানকে উনার মত ভাল থাকতে দে। আল্লাহ উনাদের ভালো রাখুক। আমার কিছুই লাগবে না। শুধু আমি মইরা গেলে উনারে একবার খবর দিস’। শ্বাস টানতে টানতে কোনরকমে কথাগুলো বলেই ভীষণভাবে কাশতে শুরু করলো আসমা। তমাল দ্রুত কাপড় ধরলো মায়ের মুখের কাছে। কাশলেই রক্ত পড়ে। তমাল বুঝতে পারে, মায়ের হাতে আর সময় নেই বেশী।
বাইরে থেকে ফজরের আযানের শব্দ ভেসে আসে। আসমা চোখ বন্ধ করে। মা ঘুমিয়ে পড়েছে মনে করে তমাল অযু করে নামাজের পাটিতে বসে। সালাম ফিরিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে, আসমা সত্যিই ঘুমিয়ে গেছে। যে ঘুম থেকে মা আর কখনও জাগবে না।
//দুই//
‘ঈদে বাড়ী গেলি না?’ মুচি ছেলেটাকে হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করে হাশেম তালুকদার।
‘না স্যার’। জুতা কালি করতে করতে সংক্ষেপে উত্তর দেয় মুচি ছেলেটি।
‘ওঃ তুই তো আবার হিন্দু!’
‘হাশেম তালুকদারের দিকে তাকিয়ে মুচকি একটু হেসে আবার ব্রাশে কালি মাখায় ছেলেটি।
‘তোর নাম কি রে? তোর বয়স কত?’ হাতের ছাতাটি নামিয়ে রেখে আবার জিজ্ঞাসা করলেন হাশেম।
‘সেলিম। বয়েস একুশ বা বাইশ হইব’। ব্রাশ ঘষতে ঘষতে উত্তর দেয় ছেলেটি। কাজের সময় বেশী কথা বলতে চায় না সে।
‘তুই মুসলমান নাকি? নামে তো তাই মনে হয়। মুসলমান ছেলে হয়ে তুই মুচির কাজ করিস?’ এবার সত্যিই অবাক হন হাশেম তালুকদার।
‘জ্বে, আমি মুসলমান। মুসলমান মুচির কাম করবার পারবো না, এমন কি কোন কথা আসে স্যার?’
‘না তা নাই! তবে আমি এমন দেখি নাই। তা তুই বাড়ী গেলি না কেন? ঈদ করবি না?’
‘বাড়ী কেউ নাই স্যার। আমি এখানেই ঈদ করুম’।
‘ভালো ভালো। আমার বাড়ী চিনিস রে?’
‘চিনি স্যার। আপনারে সবাই চিনে’।
‘ঈদে আসিস তো একবার জোহরের নামাজের পরে? পারবি আসতে?’
‘পারুম’। বলে ভাংটি টাকাগুলা হাশেম তালুকদারের হাতে দেয়। জুতা পায়ে দিয়ে হাঁটা শুরু করে হাশেম তালুকদার।
‘স্যার, আপনার ছাতাটা’। সেলিম ছাতা এগিয়ে দিয়ে অন্য একটা জুতা সেলাইর দিকে মন দেয়।
//তিন//
‘বুঝলা সাজেদা, এমন গরু কোরবানী দিলাম সে এই বাজারে সবার চোখে পড়বেই’। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন হাশেম তালুকদার। গ্যারেজে কসাইরা গরুর মাংস কাটাকুটি করছে। গেটের সামনে মাংস নেয়ার জন্য অনেক মানুষ ভিড় করে আছে। সবাইকে পরে আসতে বলা হলেও কেউ যাচ্ছে না তেমন একটা।
‘মানুষ কি দেখলো না দেখলো তাতে কি যায় আসে? কোরবানী নিয়ে যারা মাতামাতি করে, তারা কি কেউ আছে আমার ঘরে? কি করব আমি মাংস দিয়ে?’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাজেদা কথাগুলা বলেই লিফটে উঠে পড়েন।
‘কি শুরু করলা আবার, রান্না বান্না কতদূর হইলো দেখ’। হাশেম আবার চায়ের কাপে তৃপ্তির চুমুক দেয়।
জোহরের নামাজের ঘন্টাখানেক পরে কলিং বেল বাজে। দরজার কাছে ছিলেন তাই হাশেম তালুকদার নিজেই দরজা খুলে দেন। সেই মুচি ছেলেটা এসেছে। হাতে জুতা সেলাই করার বাক্সটা। সালাম জানায় হাশেম তালুকদারকে।
‘আরে সেলিম, আয় আয়। জুতার বাক্স নিয়ে নিয়ে এলি যে? আমি কি তোকে কোন কাজে ডাকছি?’
‘তাইলে আইতে কইলেন যে? সেলিম অবাক হয়।
‘আরে ব্যাটা, তোরে খাওয়াবো বলে না ডাকলাম। তুই ভাবলি কি করে আমি ঈদের দিন তোকে কাজে ডাকছি? খাবার খা। তোর জন্য মাংস রাখছি। নিয়ে যাস’।
‘স্যার, কিছু মনে কইরেন না। আমি কিছু খাব না’।
‘সে কি? খাবি না ক্যান? এটা কেমন কথা? কোরবানীর ঈদে মাংস খাবি না? তা কি হয় নাকি?’
‘না স্যার আমি মাংস খাই না’।
‘কেন খাস না?’ একটু রাগত স্বরে কৈফিয়ত তলবের সুরে জানতে চাইলেন হাশেম তালুকদার।
‘অনেক কথা স্যার। আমি যাই এখন। দেওয়ান পাড়া যাইতে হইব’।
‘কেন ওখানে কি?’
‘আইজ ওইখানে কামে বসুম। এই এলাকায় তিন দিন আসি, আর ওইখানে বাকি কয়দিন’।
‘আজ ঈদের দিনে তোকে জুতা পালিশের কাজ করতে হবে’। মনে মনে দুঃখিত হলেন হাশেম। ‘কত টাকা তুই পাস দিনে আমাকে বল। আমি দিয়ে দেই। আজকে কাজ করিস না’।
‘না স্যার। টাকার লাইগা না। সময় কাটামু কি দিয়া? হের লাইগা কাম করুম’।
‘বেশ, তোর যা খুশি তাই কর। শুধু আমার জানতে ইচ্ছা করছে যে তুই মাংস খাবি না কেন?’ হাশেম তালুকদার যথেষ্ট বিরক্ত হলেন মনে মনে।
‘স্যার, আমার পিঠাপিঠি ছোট একটা বোন ছিল। কয় বছর আগে, আমার অসুখ আছিল। কামে যাইতে পারতাম না। তখন আমার সেই বোনটা বকরী ঈদে আমার খাওনের লাইগা এক বড়লোকের বাড়ী মাংস টোকাইতে গেছিল। হেইখানে অনেক মানুষের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি আর মারামারি লাগছিল। আমার বইন মাংস আনতে গিয়া মানুষের পাড়া খাইয়া মইরা গেছিল। হের পর থেইকা গোস্ত খাইতে পারি না স্যার। গোসত দেখলেই বইনটার মরা মুখটা মনে পড়ে। আপনি কিছু মনে নিয়েন না, হের লাইগা আমি মাংস খাইতে পারি না। স্যার যাই’। হাশেম তালুকদারকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সেলিম তার জুতার বাক্স নিয়ে চলে যায়।
‘কে আসছে?’ সাজেদা রান্নাঘর থেকে একবাটি মাংস এনে টেবিলে রাখেন। মেহমানকে খাওয়াবেন বলে। এসে দেখেন স্বামী পাঞ্জাবির কোনা দিয়ে চোখ মুসছেন।
‘কি হইসে তোমার? কে আসছিল? কার যেন কথা শুনলাম?’ সাজেদা অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন।
‘কিছু না সাজেদা। এক মুচি ছেলে আজকে আমাকে বুঝায় দিল যে যে আমি আসলে কতবড় জানোয়ার ছিলাম’। বলেই হুহু করে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে ফেলেন হাশেম তালুকদার।
‘কি হইসে, কি যা তা বল?’ সস্নেহে স্বামীর কাঁধে হাত রাখেন সাজেদা।
‘আসমা গরীব ছিল বলে, আমি কোনদিন ওদের খোঁজ খবর রাখি নাই ঠিকমত। বিনা চিকিৎসায় বোনটা মারা গেছে। আমি আপন ভাই হয়েও কিছু করি নাই। আসমা কোনদিন আমাকে কিছু জানতে দেয় নাই। কিছু চায় নাই কোনদিন। আমি মানুষ না সাজেদা আমি মানুষ না। আর এই মুচি ছেলেটা, মুচি ছেলেটা...’ কান্নার দমকে কথা শেষ করতে পারেন না হাশেম তালুকদার।